বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: সম্ভাবনা একটা ছিলই। এবার তা বাস্তব হয়ে গেল। নন্দীগ্রামে তৃণমূল প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিজেপির ঘোড়া শুভেন্দু অধিকারিই। আর তারা তা পরিষ্কার করে দিল শনিবার সন্ধ্যায়। পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনে এদিন প্রথম দফায় ৫৭টি আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করল বিজেপি। আর এই ৫৭ জন প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে বড় চমক নিঃসন্দেহে শুভেন্দু অধিকারিই। তাঁকে নন্দীগ্রামে তৃণমূল প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী করা হয়েছে।
তিনিই যে বিজেপি প্রার্থী হচ্ছেন, তখনও তা জানতেন না শুভেন্দু। কিন্তু তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পরই তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোঁড়া তোপ তাঁর দিকেই ফিরিয়ে দেন। নন্দীগ্রামে সরাসরি মমতাকে ‘বহিরাগত’ বলে উল্লেখ করেন। বলেন, ‘এখানে অনেক পরিযায়ী আসছে। সব বহিরাগত। সুখের পায়রা। প্রয়োজনে আপনাদের সমর্থন নেবে। তার পর আপনাদের ভুলে যাবে। আর ফিরেও তাকাবে না। এই বহিরাগতদের নন্দীগ্রাম মেনে নেবে না। এরা শীতকালে ফোটা মরশুমি ফুলের মতো।’ উল্লেখ্য, বিজেপিকে বাংলায় ‘বহিরাগত’ বলে উল্লেখ করে বাঙালি আবেগ জাগিয়ে দিতে বিভিন্ন সভায় স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধারাবাহিক ভাবে আক্রমণ করে চলেছেন। এবার তাঁর অস্ত্রে তাঁকেই ঘায়েল করতে উদ্যোগী হয়েছেন শুভেন্দু।
এদিকে, এদিনের চমকপ্রদ খবর হল, এখনও তৃণমূল সাংসদ হিসেবে খ্যাত শিশির অধিকারি স্বয়ং প্রয়োজন হলে ছেলে তথা বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারির হয়ে নন্দীগ্রামে প্রচারে যেতে পারেন। আর এ কথা জানিয়েছেন তিনি নিজেই। এদিন তিনি বলেন, ‘যে–টুকু খবর আমি পেয়েছি, তাতে বলতে পারি, শুভেন্দু বিশাল ব্যবধানে জিতবেন। তাই তাঁর হয়ে প্রচারে যাওয়ার প্রয়োজন আমার হবে না। তবে যদি প্রয়োজন হয়, তা হলে আমি নিশ্চয়ই তাঁর হয়ে প্রচারে নন্দীগ্রামে যাব।’ কিন্তু শুভেন্দুর বিরুদ্ধে তৃণমূল প্রার্থী তো স্বয়ং তাঁরই দলনেত্রী মমতা? এই প্রশ্নের জবাবে শিশিরবাবু বলেছেন, ‘এখানে দাঁড়িয়ে মমতা ভুল করেছেন। এখানে তিনি তো জিততে পারবেন না। কেন দাঁড়িয়েছেন এখানে? ভোটের রেজাল্ট বের হলে মিলিয়ে নেবেন, ফল তাঁর পক্ষে যাবে না। শুভেন্দুই বড় ব্যবধানে জিতে আসবে।’
প্রথম দুই দফার জন্য এদিন দিল্লি থেকে বিজেপি ৫৭ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে বিজেপি। তালিকায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল, অধিকাংশ প্রার্থীই আদি বিজেপির। নব্য বিজেপি এবং আদি বিজেপি দ্বন্দ্ব যাতে মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে, সেইজন্যই এই পথে হেঁটেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। যেমন শুক্রবার তৃণমূল প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। তার পরই বঞ্চিত নেতারা দলের বিরুদ্ধেই রীতিমতো বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। অনেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। কেউ কেউ এখনও বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে চলেছেন। তবে শেষ মুহূর্তে ভিন্ন দলে যোগ দিলেও তাঁরা প্রার্থী হতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে এদিন বিজেপির প্রার্থী তালিকায় শুভেন্দু অনুগামী বেশ কয়েকজন নেতা ও নেত্রী প্রার্থী হয়েছেন। অন্যদিকে, দিল্লিতে এদিনই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী। শোনা যাচ্ছে, কলকাতার ভবানীপুরে তাঁকে প্রার্থী করতে পারে বিজেপি। ওই কেন্দ্রে এবার মমতা প্রার্থী হননি। বিরোধীদের অভিযোগ, ওই আসনটি তৃণমূলের পক্ষে নিরাপদ নয়। তাই মমতা সেখানে দাঁড়ানোর ঝুঁকি নেননি। সেখানে তৃণমূলের প্রার্থী করা হয়েছে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে।
নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারির পর ডেবরায় হেভিওয়েট প্রার্থীর নামই ঘোষণা করেছে বিজেপি। ওই আসনে তারা প্রার্থী করেছে রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশ কর্তা ভারতী ঘোষকে। উল্লেখ্য, লোকসভা নির্বাচনেও ঘাটালে বিজেপি প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। অভিনেতা দেবকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলেও দিয়েছিলেন। শেষে অবশ্য ওই আসনে দেবই জয়ী হন। প্রাক্তন পুলিশ কর্তা হিসেবে ভারতী ঘোষ ডেবরা–সহ গোটা ঘাটালকেই হাতের তালুর মতো চেনেন। পুলিশ আধিকারিক হিসেবে ডেবরা জুড়ে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তাই এবার বিধানসভা নির্বাচনেও ডেবরা কেন্দ্রে ভারতী ঘোষের ওপরই আস্থা রেখেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী করেছে আর এক আইপিএস অফিসার হুমায়ুন কবিরকে। এই হুমায়ুন কবির কর্মক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগত এবং স্নেহধন্য ছিলেন। ভোটের মুখে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সরাসরি তৃণমূলে যোগ দেন। তিনিও ডেবরাকে ভালোই চেনেন। তাই ডেবরায় এবার তুল্যমূল্য লড়াই হতে চলেছে বলে ধারণা রাজনীতি বিশ্লেষকদের।
এদিন বিজেপি প্রথম দুই দফার জন্য যে সব প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন তমলুকে হরেকৃষ্ণ বেরা, পাঁশকুড়া পূর্বে দেবব্রত পট্টনায়েক, পাঁশকুড়া পশ্চিমে পিন্টু সেনাপতি, ময়নায় অশোক দিন্দা, নন্দকুমারে নীলাঞ্জন অধিকারি, মহিষাদলে বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হলদিয়ায় তাপসী মণ্ডল, চণ্ডীপুরে পুলককান্তি গুড়িয়া, পটাশপুরে অম্বুজাক্ষ মহান্তি, কাঁথি উত্তরে সুনীতা সিংহ, ভগবানপুরে রবীন্দ্রনাথ মাইতি, খেজুরিতে শান্তনু প্রামাণিক, কাঁথি দক্ষিণে অরূপকুমার দাস, রামনগরে স্বদেশরঞ্জন নায়েক, এগরায় অরূপ দাস, বান্দোয়ানে পারসি মুর্মু, বলরামপুরে বনেশ্বর মাহাতো, জয়পুরে নরহরি মাহাতো, পুরুলিয়ায় সুদীপ মুখোপাধ্যায়, মানবাজারে গৌরী সিংহ সর্দার, পারায় নদিয়াচাঁদ বাউড়ি, রঘুনাথপুরে বিবেকানন্দ বাউড়ি, গোসাবায় চিত্ত প্রামাণিক, পাথরপ্রতিমায় অসিত হালদার, কাকদ্বীপে দীপঙ্কর জানা, সাগরে বিকাশ কামিলা।
অন্য প্রার্থীরা হলেন নয়াগ্রামে বকুল মুর্মু, গোপীবল্লভপুরে সঞ্জিত মাহাতো, ঝাড়গ্রামে সুখময় শতপথি, বিনপুরে পালন সোরেন, চন্দ্রকোনায় শিবরাম দাস, দাঁতনে শক্তিপদ নায়েক, গড়বেতায় মদন রুইদাস, মেদিনীপুরে শমিত দাস, শালবনিতে রাজীব কুণ্ডু, কেশপুরে প্রীতিশরঞ্জন কুয়ার, কেশিয়ারিতে সোনালি মুর্মু, নারায়ণগড়ে রামপ্রসাদ গিরি, সবংয়ে অমূল্য মাইতি, পিংলায় অন্তরা ভট্টাচার্য, খড়গপুরে তপন ভুঁইয়া, দাসপুরে প্রশান্ত বেরা, ঘাটালে শীতল কপাট, বাঁকুড়ায় নীলাদ্রিশেখর দানা, ছাতনায় সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায়, তালডাংরায় শ্যামলকুমার সরকার, শালতোড়ায় চন্দনা বাউড়ি, রানিবাঁধে ক্ষুদিরাম টুডু, রাইপুরে সুধাংশু হাঁসদা, সোনামুখীতে দিবাকর গোস্বামী, ওন্দায় অমর সখা, বিষ্ণুপুরে তন্ময় ঘোষ, ইন্দাসে নির্মল ধাড়া এবং কোতুলপুরে হরকালি প্রতিহার।
রবিবার কলকাতার ব্রিগেডে বিজেপির জনসভায় উপস্থিত থাকছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। থাকছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা, কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়, শিবপ্রসাদ, অরবিন্দ মেনন প্রমুখ। কলকাতা থেকে থাকছেন মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারি, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিনহা, লকেট চট্টোপাধ্যায়, অগ্নিমিত্রা পাল, রুদ্রনীল ঘোষ, যশ দাশগুপ্ত প্রমুখ। থাকতে পারেন মিঠুন চক্রবর্তী, অক্ষয় কুমার। অনেকের ধারণা, উপস্থিত থাকবেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তও। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।