বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে ফের বিতর্কে তৃণমূল। সামনের পঞ্চায়েত নির্বাচনে শুধুই তৃণমূল প্রার্থীরা থাকবেন। এ ছাড়া অন্য কোনও দলের হয়ে কেউ মনোনয়ন পত্র জমা দিতে পারবেন না। তবু যদি কেউ মনোনয়ন পত্র জমা দিতে যান, তা হলে তিনি আর ফিরবেন না। এমনই ভয়ঙ্কর ভাষায় বিরোধীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বিতর্কে তৈরি করলেন তৃণমূল নেতা আবদুর মান্নান। এই ভদ্রলোক অবশ্য বিধানসভার প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের আবদুল মান্নান নন। তিনি আবদুর মান্নান। তিনি বীরভূমে তৃণমূলের জেলা সহ–সভাপতি।
উল্লেখ্য, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনে অধিকাংশ আসনেই বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারে না বলে বহুবার অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদেরও মতে, রাজ্যের পঞ্চায়েতগুলির দিকে তাকালে বিরোধীদের অভিযোগ যে সত্য, তার প্রমাণও পাওয়া যায়। শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনেও অধিকাংশ আসনেই তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছে। এর অর্থ, সেই আসনগুলিতে বিরোধী দলের কোনও প্রার্থী ছিল না। যদিও গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীদের প্রার্থী দিতে না পারা নিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাফাই দিয়েছিলেন, ‘বিরোধীদের হয়ে কেউ যদি প্রার্থী হতে না চান, কিংবা বিরোধীরা যদি প্রার্থী খুঁজে না পান, তা হলে আমরা কী করব? আমরা তো আর তাদের হয়ে লড়াই করার জন্য প্রার্থী দিতে পারি না?’
বিষয়টি নিয়ে তাঁর দল তৃণমূলের তরফেও বলা হয়েছিল, রাজ্য জুড়ে উন্নয়নের যে কাজ তারা করছে, সাধারণ মানুষই চায় না, বিরোধী কেউ সেই কাজে বাধা তৈরি করুক। আর মানুষ চায়নি বলেই বিরোধী দলগুলি কাউকে প্রার্থী করতে পারেনি। তখন এমন অদ্ভুত বক্তব্যের সমালোচনা করেছিল কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি–সহ অনেক বিরোধী দলই। এ বছরও পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল যে একই পথ অনুসরণ করতে চলেছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল তাদের নেতা আবদুর মান্নানের বক্তব্যে। তবে এ কথা প্রকাশ্যে আসতেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছে বিজেপি। যদিও এবার বিষয়টি নিয়ে নীরব রয়েছে সিপিএম এবং কংগ্রেস।
লাভপুরের দারকা গ্রামে সোমবার তৃণমূলের একটি সভায় ওই হুমকি দেন আবদুর মান্নান। ওই সভায় স্থানীয় বিধায়ককে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে তৃণমূলে যোগ দেন সেখানকার বেশ কিছু বিজেপি কর্মী। তবে সেই বিজেপি কর্মীদের মানসিকতা নিয়ে তৃণমূল নেতা ও কর্মীদের মনে এখনও সংশয় রয়ে গিয়েছে। তাঁরা সত্যিই মন থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন কিনা, সেই প্রশ্নও অনেকের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সেই সংশয় এবং সন্দেহকেই এদিন উসকে দেন মান্নান। নবাগতদের উদ্দেশে আবদুর মান্নান বলেন, ‘বিজেপি থেকে যাঁরা যোগ দিলেন, তাঁদের পুরোপুরি তৃণমূলই হতে হবে। কারও মধ্যে যেন বিন্দুমাত্র বিজেপি–সত্তা না থাকে। থাকলে কিন্তু তাঁদের ছাড়া হবে না। তাঁদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থাই নেওয়া হবে। তাই এখন সবাই মিলে একসঙ্গে বলুন, আমরা আজ থেকে সবাই তৃণমূল।’
বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে রাজ্য জুড়ে গেরুয়া শিবির ছেড়ে দলে দলে বিজেপি কর্মী–সমর্থকরা তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। বিজেপির অভিযোগ, তাদের কর্মী–সমর্থকদের পুলিশ এবং লুম্পেনদের দিয়ে ভয় দেখিয়ে তৃণমূলে যোগ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জেলা বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, বিজেপি থেকে তৃণমূলে যাওয়া কর্মী–সমর্থকদের নিয়ে তৃণমূল নেতা ও কর্মীদের সংশয়ই প্রমাণ করছে, তাঁদের বক্তব্য ভুল নয়। বিজেপি কর্মীদের ভয় দেখিয়েই তৃণমূলে যোগদান করানো হচ্ছে। তাঁরা কেউ মন থেকে তৃণমূলে যাচ্ছেন না। তাই তাঁদের কাজ নিয়েও তৃণমূল নেতাদের মনে সন্দেহ রয়েছে। ভোটেই সাধারণ মানুষ এর জবাব দেবেন।
উল্লেখ্য, রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৩ সালে। ওই সভায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের কথা তোলেন আবদুর মান্নানই। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘পঞ্চায়েত ভোটের আর বেশি দেরি নেই। মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই ভোট হবে। এখন থেকেই সেই ভোট নিয়ে ভাবুন। আমরা প্রত্যেক বুথে একজন করে প্রার্থী ঠিক করব। সেটাই চূড়ান্ত। এই ভোটে আমার–তোমার বলে কিছু থাকবে না। সব প্রার্থীই তৃণমূলের হবে। অন্য দলের হয়ে কেউ মনোনয়ন পত্র জমা দিতে যেতে পারবেন না। যদি যান, তা হলে তিনি আর লাভপুর থেকে ফিরে আসবেন না।’ তাঁর এই কথায় বীরভূম তো বটেই, রাজ্য জুড়েই শোরগোল তৈরি হয়েছে। কংগ্রেস বা সিপিএমের তরফে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বিরোধীদের প্রার্থী দিতে না দেওয়ার জন্য তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছিল। এবার অবশ্য তারা বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।
তবে বিজেপি নেতা–সহ বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটে অনেকেই তৃণমূল নেতার এমন বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করছেন। এ বিষয়ে বোলপুরের বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘তৃণমূল জমানায় রাজ্যে গণতন্ত্র এবং মানুষের অধিকার বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। রাজ্য জুড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক দলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করতে চাইছেন। তাই বিরোধী দলগুলির কোনও অস্তিত্বই এখানে রাখতে চাইছেন না। সেই দিক থেকে তাঁর দলের যে কোনও নেতাই এমন ধরনের কথা হরবখত বলে থাকেন। মিডিয়াই শুধু প্রচার করে না। গত পঞ্চায়েত ভোটেও অধিকাংশ আসনেই তাঁরা বিরোধী দলগুলিকে প্রার্থী দিতে দেননি।’
এখানেই থেমে যাননি ওই বিজেপি নেতা। তিনি এ কথাও বলেন, ‘তার পরও পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী শক্তি হিসেবে বিজেপি উঠে এসেছে। মানুষকে সন্ত্রস্ত করলে মানুষ তার জবাব দেবেন। বাংলায় তৃণমূল শেষ হবে বিজেপির হাতেই।’