বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব নিয়ে যত বিতর্কই তৈরি হোক না কেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যে মুকুল রায়ের ওপর আস্থা রাখেন, তার প্রমাণ মিলল শনিবার। দলের সর্বভারতীয় সহসভাপতি পদে তাঁকে নিয়ে এলেন নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ। যদিও তাঁকে ওই পদে নিয়োগের কথা ঘোষণা করেন সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ (জেপি) নাড্ডা।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয়মন্ত্রী হওয়ার পর অমিত শাহ দলের সর্বভারতীয় সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। দায়িত্ব নেন জেপি নাড্ডা। তখনই ঠিক হয়েছিল আবার নতুন করে দলের সাংগঠনিক কমিটি তৈরি হবে। কিন্তু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কারণে দলের প্রধান দুই মুখ নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহরা ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তা তৈরি করা যায়নি। এবার সেই কাজটিই সম্পূর্ণ করল বিজেপি। নতুন কমিটিতে মোট ১২ জনকে সহসভাপতি করা হয়েছে। নতুন যাঁরা সহসভাপতি হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ছত্তিশগড়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রমণ সিং এবং রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া। আর বাংলা থেকে রয়েছেন একমাত্র মুকুল রায়। এই খবর শুনে ঘনিষ্ঠ মহলে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মুকুল। জানিয়েছেন, এবার বাংলা থেকে তৃণমূল হঠবেই। তাতে আর কোনও বাধা যাতে না আসে, সেই বিষয়টিই এখন তিনি সুনিশ্চিত করবেন।
কিন্তু, এরই সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, নতুন কমিটি থেকে বাদ পড়ে গেলেন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাহুল সিনহা। এই ঘটনায়ও রাজ্য রাজনীতিতে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, রাহুল সিনহাকে সর্বভারতীয় কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, এর আগে রাহুল সিনহা দীর্ঘদিন রাজ্য বিজেপির সভাপতি ছিলেন। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বে বাংলায় বিজেপি তেমন একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি। এমনকী, তিনি নিজেও বেশ কয়েকবার বিজেপির হয়ে রাজ্যে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু কোনও বারই জয়ী হতে পারেননি। তাই তাঁর রাজনীতির ওপর বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা তেমন একটা খুশি নন। সেই কারণেই এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন তাঁরা। অবিলম্বে তাঁকে নিজের ঘাটতি পূরণ করে নিতে হবে।
উল্লেখ্য, রাজ্য রাজনীতিতে তাঁর ব্যর্থতা বুঝতে পেরেই সঙ্ঘ পরিবারের চাপে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা দিলীপ ঘোষকে রাজ্য সভাপতি করেন। তিনি আসার পরই রাজ্যে বিজেপির সাফল্য আসতে শুরু করে। তবে অনেকের বক্তব্য, রাজ্যে বিজেপির সাফল্যের পেছনে দিলীপাবাবুর অবদান তেমন একটা নেই। বরং, তৃণমূল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য রাজ্যে একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া তৈরি হয়েছে। সেই সুফলই পেয়েছে বিজেপি। অবশ্য রাহুল সিনহাকে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে আরও একটি কারণ থাকতে পারে। তা হল, বাবুল সুপ্রিয় এবং দেবশ্রী চৌধুরির মতো আগামিদিনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় রাহুল সিনহাকে নিয়ে আসা হতে পারে। বিষয়টি রাহুলবাবু নিজেও শুনেছেন। তাই বিষয়টি নিয়ে সে ভাবে তিনি মুখ খোলেননি।
তবে ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি নিজের অভিমানের কথা জানিয়ে বলেছেন, এক তৃণমূল নেতার জন্যই তাঁকে সরতে হয়েছে। ইঙ্গিতটি সম্ভবত অনুপম হাজরার দিকেই। তিনি বলেছেন, ‘৪০ বছর ধরে দলের সেবা করার পুরস্কার এটাই। তৃণমূল থেকে কাউকে আসতে হবে বলে আমাকে সরতে হবে, এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কিছু হতে পারে না। আমি নিশ্চয়ই আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করব।’ কিন্তু বিষয়টি বুঝতে পেরেই দলের অনেকে তাঁকে বোঝাতে সক্রিয় হয়েছেন। স্বয়ং অনুপম হাজরা বলেছেন, ‘এটা ঠিক, রাহুল সিনহার অভিমান হয়েছে। তবে আমার বিশ্বাস, তাঁর সঙ্গে কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কিন্তু সত্যিই কি সব ঠিক হবে? প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলের।
তবে, সূত্রের খবর, এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাহুল সিনহার অভিমানের খবর জেনে তৃণমূলের একটি অংশ ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেছেন। তাঁকে যদি তৃণমূলে নিয়ে আসা যায়, তা হলে রাজ্যে বিজেপিকে একটা বড় ধাক্কা দেওয়া যেতে পারে বলে শাসক দলের অনেক নেতা মনে করছেন। কিন্তু, রাতের খবর, রাহুলবাবুর কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত তেমন একটা সাড়া তাঁরা পাননি। এদিকে, বাংলা থেকে আরও দুই নেতাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন দার্জিলিংয়ের সাংসদ রাজু সিং বিস্ত এবং অপরজন অনুপম হাজরা। দু’জনকেই সর্বভারতীয় সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়েছে।
রাজু সিং বিস্তকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে এনে উত্তরবাংলায় বিজেপি কর্মী ও সমর্থকদের একটা ইতিবাচক বার্তা দিতে চেয়েছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। তাঁর সাংগঠনিক কাজেও তাঁরা খুশি বলে জানা গিয়েছে। তবে অনুপম হাজরাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে আসায় অনেকেই বিস্মিত। কারণ, সময়ে অসময়ে সোশ্যাল মিডিয়া–সহ সংবাদ মাধ্যমে তিনি এমন সব আলটপকা মন্তব্য বা আচরণ করেছেন, যে কারণে দলকে অনেকবারই অপ্রস্তুত হতে হয়েছে। তবে অনেকে বলছেন, তৃণমূলের রমরমা থাকার সময় খুব ঝুঁকি নিয়েই তিনি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর সেই ঝুঁকিকেই মর্যাদা দিতে চেয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।