বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:নন্দীগ্রামে প্রার্থী হচ্ছেন মমতাই। শুক্রবার পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪ আসনের মধ্যে দার্জিলিংয়ের তিনটি আসন বিমল গুরংয়ের দলের জন্য ছেড়ে দিয়ে ২৯১টি আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেন তৃণমূল দলনেত্রী। আগের ঘোষণা মতোই নন্দীগ্রামে নিজে প্রার্থী হচ্ছেন বলে জানিয়ে দেন তিনি। বলেন, ‘নন্দীগ্রাম আমাকে কোনও দিন খালি হাতে ফেরায়নি। এবারও ফেরাবে না।’ কিন্তু নন্দীগ্রামে মমতা হারবেন বলে হুঙ্কার দিয়েছেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারি।
তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষিত হওয়ার পরই পাঁশকুড়ায় বিজেপির একটি জনসভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে রীতিমতো তোপ দাগেন শুভেন্দু। বলেন, ‘ভবানীপুর ছাড়লেন কেন মাননীয়া?’ উল্লেখ্য, আগেরবার মমতা ভবানীপুর থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলেন। পাঁশকুড়ার সভায় শুভেন্দু এ কথাও বলেন, ‘আজ দেখলাম, ভবানীপুরে নতুন প্রার্থী দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজের কেন্দ্র ছেড়ে পালাচ্ছেন কেন? হেরে যাবেন তো! ওখানে যে ভোটে হারতেন, তার তিনগুণ ভোটে নন্দীগ্রামেও আপনাকে হারাব।’ প্রসঙ্গত, অনেকেই মনে করছেন, এবার তৃণমূলের পক্ষে ভবানীপুর নিরাপদ নয়। লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে সামান্য ব্যবধানে এগিয়েছিল তৃণমূল। বিধানসভা নির্বাচনে সেই ব্যবধান মুছে যেতে পারে বলে রাজনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা। তাই হেরে যাওয়ার ভয়ে ভবানীপুরে তিনি প্রার্থী হননি বলে বিরোধী দলগুলি অভিযোগ তুলেছে।
সেই ইঙ্গিত দিয়ে শুভেন্দুর বক্তব্য, হেরে যাওয়ার জন্য শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন ভদ্র নেতাকে ভবানীপুরের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। শুভেন্দু আরও বলেছেন, ‘মাননীয়া ওয়েলকাম। কিন্তু মনে রাখবেন, নন্দীগ্রামে মানুষ আওয়াজ তুলেছে মেদিনীপুরের ভূমিপুত্রকে চাই, বহিরাগতকে নয়। অত সুবিধে এখানে হবে না।’ রাজনৈতিক মহলের মতে, নন্দীগ্রামে যে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, তা মমতা নিজেও মনে করছেন। তাই মমতার একটি মন্তব্য ঘিরে নতুন করে জল্পনা তৈরি হয়েছে। এদিন প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করার সময় আচমকা মমতা বলে ওঠেন, ‘টালিগঞ্জ কেন্দ্রে থেকেও আমি দাঁড়াতে পারি।’ তার পরই নিজেকে শুধরে নিয়ে টালিগঞ্জ কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে গতবারের বিধায়ক তথা মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের নাম ঘোষণা করেন তিনি। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, নন্দীগ্রামে তাঁর জেতার সম্ভাবনা কতটুকু, তা যাচাই করছেন তিনি। ইতিমধ্যে সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে নন্দীগ্রামে পাঠিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছেন। এখন সেখানে পাঠিয়েছেন পূর্ণেন্দু বসুকে। এর পরও আরও খোঁজ নেবেন। সেখানে যদি কোনও রকম ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে, তা হলে তিনি টালিগঞ্জের মতো নিরাপদ আসনে প্রার্থী হয়ে যেতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে গতবারের বিধায়ক তথা মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস কিছুটা যে মানসিক চাপে থাকবেন, সে কথা অনেকেই মনে করছেন।
এবার এক ঝাঁক তারকা শিল্পী ও খেলোয়াড়কে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। রাজ চক্রবর্তীকে প্রার্থী করা হয়েছে ব্যারাকপুর কেন্দ্রে, আসানসোল দক্ষিণে সায়নী ঘোষ, রাজারহাট–গোপালপুর কেন্দ্রে অদিতি মুন্সি, বাঁকুড়ায় সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌশানি মুখোপাধ্যায়কে কৃষ্ণনগর উত্তরে, চণ্ডীপুরে সোহম চক্রবর্তীকে, শিবপুরে মনোজ তিওয়ারিকে, মেদিনীপুর সদর কেন্দ্রে জুন মালিয়াকে, উত্তরপাড়ায় কাঞ্চন মল্লিককে, লাভলি মৈত্রকে সোনারপুর দক্ষিণ কেন্দ্রে, প্রাক্তন ফুটবলার বিদেশ বসুকে উলুবেড়িয়া পূর্ব কেন্দ্রে, বীরবাহা হাঁসদাকে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে প্রার্থী করা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক মহল মনে করছে, একমাত্র রাজারহাট–গোপালপুর কেন্দ্রে অদিতি মুন্সি ছাড়া অন্যদের জিতে আসা বেশ কঠিন। ইতিমধ্যে বাঁকুড়া কেন্দ্রে অভিনেত্রী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রার্থী করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সেখানকার নেত্রী শম্পা দরিপা। তিনি পরিষ্কার প্রশ্ন তুলেছেন, ‘বাঁকুড়া কি নিজের মেয়েকে চায় না? দল কি তাই মনে করছে? আমি জানি না।’ সায়ন্তিকাকে তিনি ‘বহিরাগত’ বলেও উল্লেখ করেছেন।
তবে বারাসত কেন্দ্রে এবার প্রার্থী থেকে গিয়েছেন অভিনেতা চিরঞ্জিত। কয়েকদিন আগে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তাঁকে প্রার্থী করা না হলে রাজনীতি ছেড়ে দিতে পারেন। শোনা যায়, তার পরই তাঁর সঙ্গে বিজেপি যোগাযোগ শুরু করে। তাই কোনও ঝুঁকি না নিয়ে তাঁকে প্রার্থী করেছেন মমতা। এবার কলকাতার এগারোটি আসনে প্রার্থী তালিকায় বেশ কিছু বদল হয়েছে। কয়েকটি আসনে পুরনো প্রার্থীরাই রয়ে গিয়েছেন। ভবানীপুর কেন্দ্রে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা বন্দরে ফিরহাদ হাকিম, রাসবিহারী কেন্দ্রে দেবাশিস কুমার, বালিগঞ্জে সুব্রত মুখোপাধ্যায়, চৌরঙ্গি কেন্দ্রে অভিনেত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামপুকুর কেন্দ্রে শশী পাঁজা, মানিকতলা কেন্দ্রে সাধন পাণ্ডে, এন্টালি কেন্দ্রে স্বর্ণকমল সাহা, বেলেঘাটা পরেশ পাল, কাশীপুর বেলগাছিয়া কেন্দ্রে অতীন ঘোষ, জোড়াসাঁকো কেন্দ্রে বিবেক গুপ্তকে প্রার্থী করা হয়েছে। হাওড়ার বালি কেন্দ্রে রানা চট্টোপাধ্যায়কে, হাওড়া উত্তরে গৌতম চৌধুরি, হাওড়া মধ্যতে অরূপ রায়, শিবপুর মনোজ তিওয়ারিকে, হাওড়া দক্ষিণে নন্দিতা চৌধুরি, সাঁকরাইলে প্রিয়া পাল, পাঁচলায় গুলশন মল্লিক, উলুবেড়িয়া পূর্বে বিদেশ বসু, উলুবেড়িয়া দক্ষিণে পুলক রায়, শ্যামপুরে কালীপদ মণ্ডল, বাগনানে অরুণাভ সেন, আমতায় সুকান্ত পাল, উদয়নারায়ণপুরে সমীরকুমার পাঁজা, জগৎবল্লভপুরে সীতানাথ ঘোষকে প্রার্থী করা হয়েছে।
এবার খড়দহ কেন্দ্রে প্রার্থী হচ্ছেন না রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। যদিও প্রার্থী তালিকায় তাঁর নাম না থাকার বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বয়স এবং অসুস্থতার জন্য তাঁকে বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে। যদিও সূত্রের খবর, অমিত মিত্র নাকি এবার নিজেই প্রার্থী হতে চাননি। কারণ, মমতার বেমক্কা ঘোষণা এবং প্রতিশ্রুতি কার্যকর করতে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নাকি তাঁকে বারবার সমস্যায় পড়তে হয়েছে। দশ বছর ধরে তিনি নাকি সেই ক্লান্তিকর কাজটিই ধারাবাহিক ভাবে করে চলেছেন। তাই এবার তিনি রেহাই চেয়েছিলেন। শেষে বয়স এবং অসুস্থতার কথা জানিয়ে নিষ্কৃতি পান। তবে তাঁর মতো একজন সজ্জন ব্যক্তি প্রার্থী না হওয়া তৃণমূলের ক্ষতি বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। তাঁর জায়গায় খড়দহে তৃণমূল প্রার্থী হয়েছেন কাজল সিং। প্রার্থী তালিকায় নাম নেই গতবারের বিধায়ক তথা মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুরও। মমতা জানিয়েছেন, নির্বাচনের পর বিধান পরিষদ গড়ে তাঁর মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জায়গা দেবেন। তবে, মমতার এই ঘোষণা আইনগত ভাবে কতখানি কার্যকর করা যাবে, তা নিয়ে দলেই সংশয় রয়েছে।
এদিকে, প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হওয়ার পর টিকিট না পাওয়া বিধায়ক ও নেতাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। গতবার বিধানসভা নির্বাচনে দলের প্রার্থী তালিকায় নাম ছিল না আরাবুল ইসলামের। কষ্ট হলেও মেনে নিয়েছিলেন। এবারও তালিকায় নাম না থাকায় ক্ষোভ গোপন করেননি তিনি। অনেক আশা করেছিলেন, এবার ভাঙড়ে তাঁকে প্রার্থী করা হবে। কিন্তু তাঁকে প্রার্থী করা হয়নি, এই খবর পাওয়ার পরই নিজের ক্ষোভ গোপন রাখেননি তিনি। বলেছেন, ‘ভুল বা ঠিক, যাই করি, সব করেছি দলের জন্য। দিদির জন্য। ভালোই প্রতিদান পেয়েছি।’ তালিকা প্রকাশ্যে আসার পর তাঁর অনুগামীরা পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান। পাশাপাশি এদিন সন্ধ্যায় আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভাঙড়ে তৃণমূলের কার্যালয় জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। প্রার্থী করা হয়নি গতবারের বিধায়ক সোনালি গুহকেও। সেই খবর জানতে পেরে কেঁদেই ফেলেন তিনি। এক সময়ে মমতার ছায়াসঙ্গী পরিষ্কার বলেছেন, ‘আমাকে মমতাদির ঘরের লোক বলে সবাই মনে করতেন। আমি জানি না কেন আমাকে প্রার্থী করা হয়নি। হয়তো তাঁর কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব, দিদির সুবুদ্ধি হোক।’
আবার ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন, প্রয়োজনের সময় মমতা সবাইকে ব্যবহার করেন। প্রয়োজন না থাকলে নাকি একসময়ের ঘনিষ্ঠদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করেন না। প্রার্থী করা হয়নি গতবারের দুই বিধায়ক জটু লাহিড়ি এবং রেজ্জাক মোল্লাকেও। প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর তাঁরা নিজেদের হতাশা গোপন রাখেননি। যদিও বয়সের কারণে দলের বিরুদ্ধাচারণ তাঁরা কতটুকু করতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। প্রার্থী করা হয়নি আগের বারের বিধায়ক মালা সাহা বা স্মিতা বকসিকেও। মালা সাহা বিষয়টি নিয়ে নীরব রয়েছেন। কারও কাছে কোনও মন্তব্য করেননি। তবে ঘনিষ্ঠ মহলে হতাশা প্রকাশ করেছেন স্মিতা বকসি। তবে খোলাখুলি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বীরভূমের নলহাটির তৃণমূল বিধায়ক মইনুদ্দিন শামস। এ বছর দলের প্রার্থী তালিকায় স্থান না পেয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি টুপি পরা মুসলমান। বালি–পাথর মাফিয়াদের সঙ্গে আপোস করতে পারিনি বলেই আমাকে প্রার্থী করা হয়নি।’ তাঁর এই বক্তব্যকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
প্রার্থী করা হয়নি বসিরহাটের বিধায়ক তথা প্রাক্তন ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাসকেও। রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, ‘আমাকে যে প্রার্থী করা হবে না, সে কথা দল আগে জানাতে পারত! এ ভাবে আমাকে অপমান করা হবে, ভাবিনি।’ এবার তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় মুসলিম প্রার্থী সংখ্যা অনেকটাই কম। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বারবার মুসলিম তোষণের অভিযোগ তুলেছে বিজেপি–সহ কিছু বিরোধী রাজনৈতিক দল। তাই হিন্দু ভোট হারানোর আশঙ্কায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবার প্রার্থী তালিকায় সচেতন ভাবেই মুসলিম মুখের সংখ্যা কমিয়ে এনেছেন।