রাঙামাটি প্রতিনিধি: মিডিয়া ব্র্যান্ডের ২০ টি এসি বিক্রি করে টাকা না পেয়ে এখন রাঙামাটির পথে পথে ঘুরছেন ঢাকার এক এসি ব্যবসায়ি। এসি বিক্রির ৭ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকার মধ্যে অগ্রিম পাওয়া ১ লক্ষ টাকা ছাড়া বাকি টাকা না পেয়ে রাঙামাটি এসে বিভিন্ন জায়গায় ধর্না দিয়ে ব্যর্থ হয়ে বুধবার রাতে রাঙামাটির কোতয়ালি থানায় অভিযোগ দিয়েছেন হান্নান মিয়া নামের ওই ব্যবসায়ি। অভিযোগে রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রাঙামাটি জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহসিনুর রহমান এবং শাহীন হায়দার নামে ঢাকার এক ব্যবসায়িকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার বিকালে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের নিকটবর্তী নির্মিতব্য হোটেল সোনার বাংলা থেকে সেই ২০ টি এসি জব্দ করে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কোতয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ কবির আহমেদ জানিয়েছেন, যেহেতু বিষয়টি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে এবং আমার লিখিত অভিযোগ পেয়েছি তাই আপাতত এসিগুলো জব্দ করে থানায় নিয়ে এসেছি। উভয় পক্ষের সাথে কথা বলে টাকার সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করব আমরা। তারপর বাকি সিদ্ধান্ত।’
সাকিরা ইলেকট্রনিক্স নামের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সত্বাধিকারি মোঃ হান্নান মিয়া জানিয়েছেন, তিনি ঢাকার মিরপুরে সাকিরা ইলেট্রনিক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং মূলত এসি ব্যবসা পরিচালনা করেন। সম্প্রতি বিক্রয় ডট কম এর মাধ্যমে শাহীন নামের এক ব্যক্তি তার সাথে যোগাযোগ করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের জন্য মাওরুম ট্রেডার্স এর মাধ্যমে ২০ টি এসি সরবরাহ করতে বলে। তারপর মহসিন ও শাহীনের সাথে দফায় দফায় কথার মাধ্যমে আমি ১ লক্ষ টাকা অগ্রীম নিয়ে ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’তে প্রথম দফায় ৯টি এবং দ্বিতীয় দফায় ১১ টি এসি সরবরাহ করার কাজ নিই। কথা ছিলো মালামাল রাঙামাটি পৌঁছালে আমাকে নগদে টাকা পরিশোধ করা হবে। কিন্তু ১৭ এপ্রিল প্রথমদফায় মিডিয়া ব্র্যান্ডের ৯ টি এসি রাঙামাটি পৌঁছালে ছাত্রলীগ সভাপতি সুজন সেই এসিগুলো রিসিভ করে এবং বাকি এসিগুলো পাওয়ার পর টাকা শোধ করবে বলে জানায়। ফলে পরদিনই আমি বাকি ১১ টি এসি পাঠাই। কিন্তু এসিগুলো রাঙামাটি আসার পর তারা জোরপূর্বক এসিগুলো নামিয়ে রাখলেও টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে। এবং আমাকে চিনেনা বলে জানায়। একই সাথে টাকার বিষয়ে মহসিনের সাথে যোগাযোগ করতে বলে। মহসিনের সাথে যোগাযোগ করলে সে শাহীনের সাথে যোগাযোগ করতে বলে। কিন্তু শাহীন আমাকে আগেই জানিয়েছিলো যে, মালামাল রাঙামাটি পৌঁছালে নগদেই পার্টি (সুজন) পরিশোধ করবে। অথচ এখন আমার টাকা না দিয়ে টালবাহানা করছে তারা। গত দুইদিন আমি রাঙামাটির বিভিন্নজনের কাছে গেছি,সবার সহযোগিতা চেয়েছি। জানিনা আমি আমার টাকা পাব কিনা।’
হান্নান মিয়ার কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগপত্র ও তথ্যপ্রমাণে দেখা যাচ্ছে যে, ১৭ তারিখ ছাত্রলীগ সভাপতি সুজন নিজে সাক্ষর করে ৯ টি এসি বুঝে নিয়েছেন,কিন্তু একইদিন ঢাকা থেকে পাঠানো এবং ১৮ তারিখ রাঙামাটি পৌঁছা বাকি ১১ টি এসি নিজে নিয়ে নিলেও তার রিসিভ কপিতে সাক্ষর করেননি। আবার এসি গ্রহণকারি হিসেবে নাম ‘মাওরুম ট্রেডার্স’ এর নাম এবং ঠিকানা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড’ আছে ! এই উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকানা দেখেই অর্ডারকারিদের বিশ^াস করেছিলেন হান্নান মিয়া।
এই বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তুষিত চাকমা বলছেন, ‘ আমরা কোন এসির অর্ডার করিনি, এই রকম কোন অর্ডারের বিষয়ও আমার জানা নাই। কেউ যদি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকানা ব্যবহার করে এই কাজ করে সেই দু:খজনক। আমি বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছি।’
অন্যদিকে মাওরুম ট্রেডার্সের সত্বাধিকার ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য এলিপন চাকমা বলছেন,‘ আমার প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে এসি কিনেছে অথচ আমি জানিনা। বিষয়টি তো দুঃখজনক। আমি মোহসিনকে ফোনে পাইনি,সুজনকে পেয়েছি,সে অস্বীকার করেছে,সে বলছে আমার প্রতিষ্ঠানের নামে কিছু হয়নি।’ তাহলে রিসিভ ও চালানে কেনো তার প্রতিষ্ঠানের নাম,সেটা জানতে চাইলে, তিনি বলেন- এটা তো হওয়ার কথা না।’
এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা মোহসিুনর রহমান বলেন, এসি আমি অর্ডার করেছি এটা সত্য এবং এসিগুলো আমি সুজনের কাছে বিক্রির জন্যই অর্ডার করেছি। কিন্তু যার মধ্যস্থতায় অর্ডার করেছি সেই শাহীনের সাথে আমার কিছু ব্যবসায়িক লেনদেন আছে। তার কাছে আমি টাকা পাই। তাই হান্নান মিয়ার টাকার বিষয়ে আমি কিছু জানিনা।’
তবে ছাত্রলীগ সভাপতি সুজন বলছেন, আমি সোনার বাংলা হোটেলে এসি সরবরাহের কাজ নিয়ে মহসিনকে অর্ডার করেছি,সে কোথা থেকে কার কাছ থেকে এসি এনেছে আমি জানিনা। আমি মালামাল পেয়েছি,বুঝে নিয়েছি। মহসিনকে আমি টাকা দিয়েছি, বাকি কিছুই আমার জানা নাই।’ ‘জোর করে এসি নামিয়ে রেখে টাকা না দেয়ার অভিযোগ’ অস্বীকার করে তিনি বলেন,‘ আমার মাল আমি নামিয়ে নিয়েছি স্বাভাবিকভাবেই,জোর করব কেন।’ এসির প্রথম চালানের রিসিভে সাক্ষর করলেও পরের ১১টির রিসিভে সাক্ষর না করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইফতারির কারণে আমি ব্যস্ত ছিলাম,তাই সাক্ষর করার বিষয়টি মনে ছিলোনা।’ হান্নান মিয়াকে তিনি চিনেননা জানালেও প্রথম দফার এসি রিসিভ করার কাগজে হান্নান মিয়ার সাক্ষরের ঠিক পাশেই সাক্ষর করেছেন জেলা ছাত্রলীগের এই আলোচিত সভাপতি। হান্নান মিয়া বুধবার তার সাথে দেখা করলে ‘শাহীন কিংবা হান্নান’কে চিনেন না বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে শাহীন হায়দার নামের ঢাকার ওই ব্যবসায়ি বলছেন,‘কিছুদিন আগে ধানমন্ডিতে উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমার জন্য একটি ফ্ল্যাট কেনার বিষয় নিয়ে আমার সাথে মহসিনের পরিচয় হয়। সে আমাকে এসি’র বিষয়টি জানালে আমি বিক্রয় ডট কমের মাধ্যমে ওই ব্যবসায়ির সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিই। প্রাথমিকভাবে ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা প্রদান এবং রাঙামাটিতে নিয়ে যাওয়ার গাড়ী ভাড়াও দেয় মহসিন। বাকি টাকা মালামাল রাঙামাটি গেলে বুঝে নিয়ে নগদে দেয়ার কথা। কিন্তু মালামাল রাঙামাটি যাওয়ার পর মহসিন দীর্ঘ সময় ধরে তাদের গাড়ীসহ সেখানে বসিয়ে রাখে এবং আমাকে হোয়াটসআপ মেসেজে জানায় যে, সে টাকা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। পরে ছাত্রলীগ সভাপতি সুজন টাকা না দিয়ে জোর করে মাল নামিয়ে রাখে। বিষয়টি খুবই আপত্তিকর এবং দু:খজনক। আমি এই বিষয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’ ‘মহসিনের সাথে কোন প্রকার আর্থিক লেনদেন নেই’ দাবি করে এই ব্যবসায়ি এই প্রতিবেদককে তার সাথে মহসিনের কথোপকথনের বেশকিছু স্ক্রিনশট পাঠান। তিনি দাবি করেন, ‘এসির অর্ডার দিয়ে মহসিন এবং সুজন এখন প্রতারণা করছে।’
এই বিষয়ে একটি অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে কোতয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ কবির আহমেদ বলছেন, একটা লিখিত অভিযোগ আমরা পেয়েছি,বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। এরই মধ্যে এসপি স্যারের নির্দেশ এসিগুলো আমরা জব্দ করে থানায় নিয়ে এসেছি।’
এদিকে টাকা না পেয়ে বুধ ও বৃহস্পতিবার সারাদিন রাত রাঙামাটির বিভিন্ন প্রশাসন ও ব্যক্তির দ্বারে দ্বারে ঘোরা এসি ব্যবসায়ি হান্নান মিয়া বলেন, আমি ছোট ব্যবসায়ি। এই টাকা না পেলে আমি মরে যাব। আমি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকানা দেখে তাদের বিশ^াস করেছিলাম, এখন তারা আমাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা।’ এ বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এই ব্যবসায়ি।
বিকালে এসি জব্দ করার পর মোঃ হান্নান মিয়া রাঙামাটির স্থানীয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, আমি ডিসি স্যারকে ফোন করার পর স্যার আমাকে এসপি স্যারের কাছে পাঠান। এসপি স্যার আমার সব কথা শুনে এবং কাগজপত্র দেখে তাৎক্ষণিক এসিগুলো জব্দ করার নির্দেশ দেন। আমি রাঙামাটির প্রশাসন ও সাংবাদিকদের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’ এই ক্ষেত্রে রাঙামাটিবাসীর কাছে প্রশংসিত।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিষয়টি আমি জেনেছি। ওই লোক আমাকে জানানোর পর আমি তাকে পুলিশ সুপারের কাছে পাঠিয়েছি। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারেই দেখব।’