চৌধুরী হারুনুর রশীদ,রাঙ্গামাটি: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, আমাদের টার্গেট হলো বাংলাদেশে আমরা কোন চাঁদাবাজি করতে দেব না। বাংলাদেশে তথা পাহাড়ে আমরা কোন রক্তপাত হতে দিব না। কেন এই তিন জেলায় রক্তপাত ও সংঘাত হবে? আপনাদের (পাহাড়ের) প্রত্যেক জেলায় আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি, অনেক সাধারণ মানুষ আপনারা। কোন ডিমান্ড নেই। আপনারা অত্যন্ত শান্তি প্রিয় মানুষ। তাহলে কেন এই রক্তপাত- সেটাই জিজ্ঞাসা। আপনাদের কাছে আমরা ওয়াদা করছি, পুলিশ বাহিনী আপনাদের পাশে থাকবে। আপনারা যে যেভাবে হোক প্রতিরোধ করুন, সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে আমাদের জানান।
বৃহস্পতিবার দুপুরে (২৬ মে) রাঙ্গামাটির শহরের সুখীনীলগঞ্জ পুলিশ লাইনসে ডিআইজি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নস্ (পার্বত্য জেলাসূমহ) ও তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেছেন। সকাল দশটায় ব্যাটালিয়নের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উদ্বোধন করা হয়।
সভায় মন্ত্রী আরও বলেন, আমরা অবশ্যই সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ; যারা নামে-বেনামে চাঁদাবাজি করছে, রক্তপাত করছে তাদের আইনের মুখোমুখি করব। এটাই আমাদের ওয়াদা। তাদের আইনের মুখোমুখি হতে হবে। আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতেও হবে। এই তিন জেলায় প্রচুর সম্ভাবনার জায়গা। পাহাড়ের কাজু বাদামের সফলতা দু-এক বছরের মধ্যে দেখতে পারবেন। এই যে সফলতার দেশ, শান্তি প্রিয় মানুষগুলোর দেশ; এখানে কেন রক্তপাত কেন। তাই আমাদের সরকারিভাবে যা করণের আমরা করছি।
অনুষ্ঠানে জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ আক্তার হোসেনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার, খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য বাসন্তী চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়, সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ।
জনপ্রতিনিধিদের কথা উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান খান বলেন, এখানকার তিন এমপি এবং আরও যারা আসছেন- সবারই এক কথা এগুলা বন্ধ করতে হবে। সবাই যখন চাচ্ছেন, আশাকরি আমরা অবশ্যই সফল হব। সফল হতেই হবে। আমরা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছি আমরা অনেক কিছুই পারি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী চাই তিন জেলাটা সুন্দর, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকুক, আপনারাও শান্তি চান তাহলে অবশ্যই হবে। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করবেন। এখন শুনছি আমাদের বাঙালি ভাইয়েরাও নাকি তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আপনাদের চরম বিপর্যয় চলে আসবে; আমরা যদি এসবের প্রমাণ পাই।
তিনি বলেন, আমি ঘোষণা দিয়ে বলতে চাই, এখানে রক্তপাত চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য যা যা করা দরকার আমরা তাই করব। এই সম্ভাবনাময়ী এলাকা হিসেবে আমরা যা চিন্তা করেছি সেটা বানিয়ে পৃথিবীতে দেখিয়ে দেবো।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন,ড.বেনজির আহম্মেদ বলেন, পাহাড়ে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে ৫ বছরে খুন হয়েছে ১৩৫ জন দুইমাসে গড়ে ৫জন ,উপদলীয় কোন্দল চাদাবাজি কারণে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে । প্রাকৃতিক অপরুপ সৌন্দর্য্য ( সুজারল্যান্ড খাত) প্রচুর টুরিজম সম্ভবনা খাতকে কাজে লাগাতে হবে। এইদেশের ১৮ কোটি মানুষ আপনাদের সাথে আছে। মাত্র হাজার দুয়েক দুস্কৃতিকারী যেখানে থাকবে মাটির তলে থেকে তুলে নিয়ে আসবো, পাহাড়ে ১৬ লক্ষ মানুষকে মানুষকে নিরাপক্তা নিশ্চিত করতে হবে।
চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেন, রাঙ্গামাটি জেলায় ৩৮০ জন হেডম্যান ৪হাজার কারবারী প্রথাগত আইন অনুযায়ী শান্তি শৃংখলা প্রতিষ্ঠা সফলতা কামনা করেন।
২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জয়নাল আবেদীন বলেন,পাহাড়ে উপজাতীয় জনসংখ্যা ৫১ শতাংশ শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ ,অউপজাতীয় ৪৯ শতাংশ শিক্ষার হার ২৩ শতাংশ । এখানে অবহেলিত অউপজাতীয়রা তাই উপজাতীয় কোঠা বাতিল করে মেধাভিক্তিক প্রতিযোগিতা সর্বক্ষেত্রে সমন্নয় নিয়ে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্টমন্ত্রীর নিকট দৃষ্ট্রি আকর্ষণ করেন তিনি।
বক্তব্য রাখেন জননিরাপক্তা বিভাগের সিনিয়ার সচিব আকতার হোসেন,এপিবিএন মহাপরিচালক হাসানুল হায়দার ।
এসময় পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশেসিং খাগড়াছড়ি এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা . রাঙ্গামাটির এমপি দীপংকর তালুকদার ,সংরক্ষিত মহিলা এমপি বাসন্তি চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী, রাঙ্গামাটি জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, পুলিশ সুপার মীর মোদদাছছের হোসেন, তিন জেলার সার্কে তিন পার্বত্য জেলার উপজেলা পরিষদচেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-সদস্য, হেডম্যান-কারবারিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনা করা ক্যাম্পসমূহগুলো রাঙ্গামাটির আঠারো মাইল ক্যাম্প (১৮ এপিবিএন), বান্দরবানের রাবার বাগান ক্যাম্প (১৯ এপিবিএন) ও খাগড়াছড়ির পুরাতন পক্ষীমোড়া ক্যাম্প (২০ এপিবিএন)৷ এছাড়া রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি- এই তিন জেলায় ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার্স এবং রাঙ্গামাটিস্থ পার্বত্য জেলাসমূহের কার্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।
তার আগে বুধবার (২৫ মে) রাতদশটায় রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই তিন পার্বত্য জেলার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত এক বিশেষ সভা শেষে তিনি এসব কথা বলেছেন।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সম্মেলনে কক্ষে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক শেষে তিনি আরও বলেন, তিন সার্কেল চীফ,’হেডম্যান-কারবারি, জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রী তাদের একটা বিষয় আসছিল পাহাড়ে শান্তির জন্য। ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা তারা বলছেন। চাঁদাবাজির কথা তারা বলছেন, সন্ত্রাসের কথা বলছেন। উপদলের মারামারির কথা বলছেন। এই লক্ষে যারা শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন, তাদের সঙ্গে আমরা আলাপ আলোচনা করেছি। দাদার সঙ্গে (সন্তু লারমা) শান্তি চুক্রি হয়েছিল, সেই চুক্তির একটি শর্ত ছিল সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার। সেই পরিত্যক্ত ক্যাম্পগুলোতে পুলিশ আনাব, যাতে করে ওই এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা অব্যাহত থাকে। লক্ষ্য একটাই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সুবাতাস যেন অব্যাহত থাকে। আপনারা এও জানেন, আমরা জলদস্যু মুক্ত করেছি, চরমপন্থী মুক্ত করেছি।’
এদিন সন্ধ্যা পৌনে আটটায় শুরু হওয়া দুই ঘন্টার এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকের শেষ হয় রাত পৌনে দশটায়। বৈঠক শেষ সাংবাদিকদের সার্বিক বিষয়ে ব্রিফ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, মন্ত্রীপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় মো: জাহাজ্ঞীর আলম,সিনিয়ার সচিব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, অতিরিক্ত সচিব এ কে মোখলেছুর রহমান,সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল ষ্টাফ অফিসার, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা), রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার, খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য বাসন্তী চাকমা, পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মহাপরিচালক মেজর টি এম জোবায়ের,ডিজিএফআই মহাপরিচালক, ৩০৫ রিজিয়ন কমান্ডার ,বিভাগীয় কমিশনার আসরাফুল ইসলাম, তিন পার্বত্য জেলার জেলাপ্রশাসক ও পুলিশ সুপার ,তিনজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এর আগে ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর তিন পার্বত্য জেলার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিশেষ সভা করা হয়। সেই সভাতেও পাহাড়ের সারবিক পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক শেষে ব্রিফিং করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।