বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:বিজেপির নবান্ন অভিযান ঘিরে ধুন্ধুমার কলকাতা ও হাওড়ায়। বিদ্যাসাগর সেতু থেকে কলকাতার বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে এদিন কাতারে কাতারে বিজেপি কর্মী–সমর্থকরা নবান্ন অভিমুখে রওনা দিলেও বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেড করে মিছিল আটকে দেয় পুলিশ। বিজেপি কর্মীদের রুখতে মুহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায় তারা। এমনকী জলকামানে রাসায়নিক ও রং মিশ্রিত জল ছোঁড়ারও অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ওই তীব্র বেগে আসা জলের মুখে পড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন বহু বিজেপি নেতা, কর্মী ও সমর্থক। তাঁদের অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিনের মিছিলে ছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যের শীর্ষস্তরের নেতারা। তবে এদিন মিছিলে দেখা যায়নি বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহাকে।
অভিযোগ, জলকামানের রাসায়নিক মিশ্রিত জলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন বিজেপি নেতা রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিযান চলাকালীন রাস্তায় তিনি রক্তবমিও করেন। তাঁকে ইস্টার্ন বাইপাসের অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এই ঘটনায় বিজেপি কর্মীরা উত্তেজিত ও মারমুখী হয়ে ওঠেন। একই ভাবে পুলিশের আক্রমণে হাওড়ার সাঁতরাগাছিতে জখম হয়েছেন বিজেপি নেতা জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো। তিনি অভিযোগ করেছেন, ‘পুলিশ, সিভিক ভলান্টিয়ারের পাশাপাশি তৃণমূল আশ্রিত গুন্ডারা মিছিল লক্ষ্য করে ইট–পাটকেল ছুঁড়েছে। বিনাপ্ররোচনায় পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ করে।’ এ ছাড়া পুলিশের জলকামান ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়ায় কম–বেশি আহত হয়েছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা অরবিন্দ মেনন, বিজেপির যুব মোর্চার সহ সভাপতি তাপস ঘোষ, বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু প্রমুখ। এদিনের বিভিন্ন মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাংসদ অর্জুন সিং, সৌমিত্র খাঁ, কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়, যুব মোর্চার সর্বভারতীয় সভাপতি তেজস্বী সূর্য প্রমুখ। যুব মোর্চার মিছিলে পুলিশ যে অত্যাচার চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধে মৌনী মিছিলের ডাক দিয়েছে বিজেপি। বৃহস্পতিবার এ কথা জানান রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু। তিনি জানান, শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটের সময় ওই মিছিল কলকাতায় দলের প্রধান কার্যালয় থেকে বের হবে। মেয়ো রোডে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে গিয়ে মিছিল শেষ হবে।
এদিনের কর্মসূচি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে যুব মোর্চার সর্বভারতীয় সভাপতি তেজস্বী সূর্য বলেছেন, ‘যে ভাবে বিজেপির যুব কর্মীদের ওপর আজ হামলা চালানো হয়েছে, তা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে কালো অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে। কিন্তু পশ্চিমবাংলার সরকারের এ কথা মনে রাখা উচিত, যতই হামলা তারা বিজেপির কর্মী–সমর্থকদের ওপর করুক না কেন, কিছুতেই বিজেপির আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে পারবে না। আজকের নবান্ন অভিযান থেকে এটা পরিষ্কার যে, রাজ্যে বিজেপির শক্তিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভয় পেয়ে গিয়েছেন। তাই পুলিশকে তৃণমূল ক্যাডারের মতো আচরণ করতে বাধ্য করছেন। তাই এই আন্দোলন রুখতে এত মরিয়া হয়ে উঠেছেন। কিন্তু একটা কথা আজ পরিষ্কার করে দিতে চাই, আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নবান্ন ছাড়া করে তবেই থামব। আগামী বছরই রাজ্যে পালাবদল হবে।’
এদিন বিজেপির কর্মসূচিতে অশান্তি প্রসঙ্গে রাজ্যের মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘অতিমারি পরিস্থিতিতে এ ভাবে মিছিল করা যায় না। তা ছাড়া, সুপ্রিম কোর্টও এক নির্দেশিকায় এ ভাবে মিছিল–মিটিং করা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তবু, শেষ পর্যন্ত আমরা নিয়ম মেনে বিজেপিকে মিছিল করার অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু মিছিলে বিধিভঙ্গ হয়েছে। একসঙ্গে ২৫ হাজার মানুষ জমায়েত করেছেন। এই অবস্থায় পুলিশ যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে। তাই কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’ কিন্তু বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আমরা স্বাভাবিক ভাবেই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ বেপরোয়া ভাবে লাঠিচার্জ করে। রাসায়নিক মেশানো জল স্প্রে করে জলকামান থেকে। এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কোনও বিরোধী স্বর রাখতে চান না, এদিনের ঘটনায় সে কথাই আবার প্রমাণিত হল। কিন্তু এ ভাবে বিজেপিকে রোখা যায় না। তিনি যদি ভেবে থাকেন, পুলিশের ভয় দেখিয়ে, পুলিশকে দিয়ে অত্যাচার চালিয়ে বিজেপিকে রুখে দেবেন, তা হলে ভুল করছেন। বিজেপির কর্মসূচিতে ভয় পেয়েই আজ নবান্ন বন্ধ করে দিয়ে চলে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার পুলিশ দিয়ে জাতীয় সড়ক বন্ধ করে দিয়েছেন। গঙ্গায় বন্ধ করে দিয়েছেন ফেরি পরিষেবাও। এই সরকারের উদ্দেশ্যটা যে কী, তা বুঝতে কি কারও বাকি আছে?’
বিজেপি যুব মোর্চার এই কর্মসূচি সম্পর্কে বলতে গিয়ে দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘এই রাজ্যে তৃণমূল সরকার ও দলের হয়ে কাজ করছে পুলিশ। এটা আজ আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে। না হলে একটা মিছিল আটকাতে পুলিশ এ ভাবে বিজেপির কর্মী–সমর্থক ও নেতাদের ওপর আক্রমণ চালাত না। তারা আজ দিশাহীনের মতো আচরণ করছে। সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে কাজ করছে না, সরকারের বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করছে, তাদের ওপর অত্যাচার করাটাই এখন পুলিশের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ কিন্তু, পুলিশ অভিযোগ করেছে, এক বিজেপি কর্মীর কাছে নাকি আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গিয়েছে! দিলীপবাবু পরিষ্কার বলেন, ‘হ্যাঁ, পাওয়া গিয়েছে। তাতে হল কী? ওটা তো লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্র। আমার দেহরক্ষীর কাছেও লাইসেন্সপ্রাপ্ত বন্দুক থাকে। আমাদের এক কর্মী নিজের নিরাপত্তার জন্যই ওটা নিজের কাছে রেখেছিলেন। এই অস্ত্র রাখার মধ্যে কোনও নিয়মভঙ্গ হয়নি। কারণ, এখানকার পুলিশকে সকলেই বুঝে গিয়েছেন। ওই অস্ত্র পুলিশকে ফিরিয়ে দিতে হবে।’
বিজেপির নবান্ন অভিযান ঘিরে অশান্তি প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয় মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বিজেপিকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিজেপি কোনও রাজনৈতিক দল নয়, এটা সন্ত্রাসবাদীদের দল। বাংলার শান্তি বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছে তারা। এ–সব এখানে চলবে না। মানুষই তাদের মুখের ওপর জবাব দেবে। অশান্তি রুখতে পুলিশকে সব রকম স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক দলের মিছিলে কখনও অস্ত্র থাকে না, স্লোগান থাকে, পোস্টার–ফেস্টুন থাকে।’ উল্লেখ্য, অতিমারি রুখতে এদিন জীবাণুনাশক স্প্রে করা হবে বলে নবান্নের সমস্ত দফতরে ছুটি ঘোষণা করে রাজ্য সরকার। কিন্তু এদিনের অভিযানের কর্মসূচি অনেক আগে থেকেই ঘোষণা করেছিল বিজেপি যুব–মোর্চা। তাই এই দুই ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ।