বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:ভারতের স্বাধীনতার জন্য প্রথমবার বাংলা ভাগ হয়। তৈরি হয় বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) এবং পশ্চিমবাংলা। এর পরও ফের পশ্চিমবাংলা ভাগ হয়। বিহারের সঙ্গে জুড়ে যায় রাজ্যের একটা বেশ বড় অংশ। পরে বিহার ভাগ হয়ে ঝাড়খণ্ড তৈরি হলে সেই অংশ নতুন রাজ্যে স্থান পায়। এখানেই শেষ নয়। এর পরও পশ্চিমবাংলা ভাগ চাইছেন বেশ কিছু ব্যক্তি ও দল। যেমন বিমল গুরুংরা চান দার্জিলিং ভাগ করে পৃথক গোর্খাল্যান্ড, আগে যে দাবি করেছিলেন সুভাষ ঘিসিংরা। আর কামতাপুরিরা চান কোচবিহার–সহ উত্তরবাংলার কিছু অংশ নিয়ে পৃথক রাজ্য।
বাংলায় সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম সরকার যেমন গোর্খাল্যান্ডের দাবি মানেনি। তেমনই তৃণমূল সরকারও মানেনি। তাই বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন বিমল গুরুংরা। তখন কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপি ছিল বিরোধী স্থানে। পশ্চিমবাংলায় তেমন শক্তি তাদের ছিল না। তাই তাৎক্ষণিক লাভে সঙ্গত করে গিয়েছিল বিমল গুরুংদের। কিন্তু ভারতের ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট কিন্তু গোর্খাল্যান্ডের দাবি মেনে নিতে পারেনি। তা ছাড়া, পশ্চিমবাংলায় বিজেপির মাটি এখন যথেষ্ট মজবুত। তারা এখন বাংলার ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে। পাশাপাশি বাংলার বিজেপি নেতারা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা গোর্খাল্যান্ড সমর্থন করেন না। তাই বিমল গুরুংদের সে ভাবে সহায়তা করতে পারছেন না বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এদিকে, রাজ্যে তৃণমূলের বিরোধিতা এবং গোর্খাল্যান্ডের দাবি করে রাজ্যছাড়া ছিলেন বিমল গুরুং। কিন্তু মঙ্গলবার বিকেলে আচমকাই অজ্ঞাতবাস ছেড়ে কলকাতায় হাজির হন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মোর্চার প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি। সল্টলেকের দার্জিলিং ভবনে গেলেও সেই ভবনের দরজা তাঁকে খুলে দেওয়া হয়নি। আধঘণ্টা অপেক্ষা করে তিনি ফিরে যান।
পরে কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সেখানেই তিনি তোপ দাগেন বিজেপির বিরুদ্ধে। পরে তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্যই দার্জিলিংয়ে বিজেপি বারবার জিতেছে। কিন্তু আমাদের হাজারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তারা গোর্খাল্যান্ডের ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ করেনি। তাই বিজেপির সঙ্গে আমরা সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করছি। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার সবই রক্ষা করেছেন। একুশের নির্বাচনে তাঁর পাশে থেকেই আমরা লড়াই করব। আমরা তৃণমূলের সঙ্গে মিলে বিজেপিকে জবাব দেব।’ কিন্তু, পাশাপাশি তিনি এ কথাও জানিয়ে দেন, গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে তাঁরা সরছেন না। তার পরই এই ঘটনা নিয়ে তীব্র বিতর্ক দেখা দেয় বাংলার রাজনীতিতে। যদিও দার্জিলিংয়ে নিজেদের জমি মজবুত রাখতে মোর্চা নেতার এই ইচ্ছেকে উড়িয়েও দেয়নি তৃণমূল। এদিন রাতে দলের তরফে যে টুইট করা হয়, তাতে পরিষ্কার, তারা বিমল গুরুংকে পাশে রাখতে চলেছে। আর এদিন বিমল গুরুংয়ের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপির তীব্র সমালোচনাও তারা করেছে। সেই সঙ্গে বিজেপির সঙ্গ ত্যাগের জন্য বিমল গুরুংকে ধন্যবাদও জানানো হয় ওই টুইটে।
এ দিকে সূত্রের খবর, তৃণমূলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোরের মাধ্যমেই পাহাড়ের একদা প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছিল। এ ক্ষেত্রে রাজ্যের এক মন্ত্রীর ভূমিকাও ছিল বলে রাজনৈতিক মহলের খবর। এদিকে, এই ঘটনায় একটু হলেও অস্বস্তিতে পড়েছে বিজেপি। তবে তৃণমূলকে রাজনৈতিক আক্রমণের সুযোগ তারা ছাড়েনি। দলের নেতা সায়ন্তন বসু বলেছেন, ‘এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, এতদিন তৃণমূল যে বাংলা ভাগের বিরোধিতা করে এসেছে, তা মিথ্যে ছিল। এতদিন মানুষকে ভুল বুঝিয়ে এসেছে তারা। এখন তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। তাই গোর্খাল্যান্ডের দাবিদার বিমল গুরুংয়ের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে তারা।’ রাতে মুখ খোলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ স্বয়ং। তিনি বলেন, ‘গোর্খাল্যান্ড করে দেব, এমন কথা আমরা কখনও বলিনি। গোর্খাল্যান্ড তাদের ইস্যু। আমরা পাহাড়ে স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছিলাম। ব্যাপারটা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বারবার চেষ্টা করেছে। রাজ্যের অসহযোগিতায় তা সম্ভব হয়নি।’
অন্যদিকে, বিমল গুরুংয়ের বিরোধী, আবার তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিনয় তামাং বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। কিন্তু বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস বিধায়ক আবদুল মান্নান বলেছেন, ‘পাহাড় যে হাসছে না, তা আরও একবার স্পষ্ট হয়ে গেল। তিন বছর ধরে যে চোর–পুলিশ খেলার নাটক চলেছে, তা এবার সবার সামনে চলে এসেছে।’ পাশাপাশি তিনি মনে করিয়ে দেন, এই বিমল গুরুংই এক সময় মুখ্যমন্ত্রীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় বিজেপির সঙ্গে চলে যান। সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘এটাই তো স্বাভাবিক। এটাই ভবিতব্য। ২০১১ সালে পাহাড়ে ভোট জেতার জন্য বিমল গুরুংকে ব্যবহার করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁর সব কাজে মদত দিয়েছিলেন। তার পর দুই পক্ষের গোলমালে বন্ধুত্ব ভেঙে যায়। এখন বোঝা যাচ্ছে, তিন বছর ধরে বিমল গুরুং কোথায় লুকিয়ে ছিলেন! আসলে দুই পক্ষের মধ্যে যে বোঝাপড়া ছিল, তা আজ প্রমাণিত হয়ে গেল।’