পশ্চিমবঙ্গ সংবাদদাতা : অনেকবার বলেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতি শোনেনি মা মেনকার কাতর আর্তি। নবমী নিশি কেটে গিয়েছে। এসেছে দশমী। তবু বেপরোয়া হয়ে তিনি মেয়ে উমাকে বলেছেন, ‘তুই নাকি যাবি আমার ঘর শ্মশান করে?’ উমার মুখে কোনও জবাব ছিল না। কীই বা জবাব দেবে উমা! মেনকাও বুঝে গিয়েছেন কী হতে চলেছে! বাধ্য হয়েই মিষ্টিমুখ করিয়ে জলভরা চোখে বিদায় দিয়েছেন মেয়েকে। পাঁচদিন বাপের বাড়িতে কাটিয়ে উমা রওনা হয়ে গিয়েছে কৈলাসে শ্বশুর বাড়িতে।
বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো শেষ হয়ে গেল সোমবার। বিষাদের বিজয়া পালন করলেন পশ্চিমবাংলার মানুষ। কোভিড পরিস্থিতিতে কাছাকাছি যাওয়া গেল না, আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়া গেল না। দূর থেকে নমস্কার বিনিময়। তার পর মিষ্টিমুখ। আগামিদিনগুলি যাতে মধুময় হয়ে ওঠে, সেই আশা নিয়েই দশমী কাটিয়ে দিলেন অগণিত বাঙালি।
উৎসব শেষে বিষণ্ণ বাংলা। দুর্গাপুজোর শেষদিন ছিল এদিন। দেবীবরণের পর বাঙালি মহিলারা মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায়। তবে করোনা পরিস্থিতিতে সার্বিক ভাবে সিঁদুর খেলা এদিন কোথাও হয়নি। যে–টুকু হয়েছে, তা স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে। দুপুর গড়াতেই শুরু হয়ে যায় প্রতিমা বিসর্জন। তবে সে ভাবে কোথাও শোভাযাত্রা দেখা যায়নি। থাকার মধ্যে ছিল দুর্গাপুজোর অনুষঙ্গ ঢাক বাজানো। দুপুর, বিকেল এবং সন্ধ্যায় বেশির ভাগ বাড়ির পুজোর প্রতিমা নিরঞ্জিত হয়। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে বারোয়ারি পুজোর প্রতিমা নিরঞ্জন। এ বছর রাজ্য প্রশাসনের তরফে প্রতিমা নিরঞ্জনের শেষ তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ২৯ অক্টোবর। তবে ২৮ তারিখের মধ্যেই সব মণ্ডপের প্রতিমা নিরঞ্জন হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কলকাতা পুলিশের আওতায় ২৪টি মূল ঘাট–সহ ৩০টি ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন হচ্ছে। মূল ঘাটগুলির মধ্যে রাজাবাগান, দক্ষিণ বন্দর থানা এলাকায় তিনটি ও উত্তর বন্দর এলাকায় ১৮টিতে বিসর্জন হচ্ছে। প্রতিমা বিসর্জন চলছে বাগবাজার, নিমতলা, বাবুঘাট, জজেস ঘাটের মতো বিখ্যাত ঘাটগুলিতেও। এ ছাড়াও রয়েছে ৬টি ছোট ছোট ঘাট, সেখানেও দেওয়া হচ্ছে বিসর্জন। বিসর্জনের ঘাটে পুলিশি কড়াকড়ি ছিল যথেষ্ট। প্রতিটি বিসর্জনে ৪–৫ জনের বেশি ব্যক্তিকে ঘাটে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এদিন দুপুরে কলকাতার মূল ঘাটগুলি পরিদর্শনে যান মহানগরীর পুর প্রধান প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম।
এদিকে, এদিন করোনা আবহে ইছামতী দেখল দুই বাংলার মিলনের বিবর্ণ ছবি। আগে সীমান্তের বাধা পেরিয়ে বিজয়ার মিষ্টিমুখ ও শুভেচ্ছা বিনিময় চলত সহজেই। টাকির ইছামতী নদীতে এটাই ছিল চিরচেনা ছবি। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতিতে এদিন চিরচেনা ছবিটা ছিল না। বিএসএফ, রাজ্য পুলিশ, পুরসভার নিষেধাজ্ঞায় এদিন টাকিতে ইছামতীতে ভাসান হয়েছে জৌলুসহীন। দর্শনার্থীদেরও তেমন ভিড় ছিল না। নদীতে হাতেগোনা কিছু নৌকো চলাফেরা করে।
সকাল থেকেই ইছামতীতে বিসর্জন শুরু হয়ে গিয়েছিল। সৈয়দপুর টাকি জমিদার বাড়ির দেবীবরণ ও সিঁদুর খেলা শেষ হওয়ার পর দুপুরের কিছু আগে তিথি মেনে ইছামতীতে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। এ ছাড়া আরও কয়েকটি বনেদি বাঙালি বাড়ির দুর্গা প্রতিমাও নিরঞ্জিত হয় এদিন। এদিন জমিদার বাড়ি এবং প্রশাসনের তরফে নদীর পাড়ে উপস্থিত দর্শনার্থীদের হাতে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার বিলি করা হয়।
বিসর্জনে রীতিমতো চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত স্থাপন করল ত্রিধারা সম্মিলনী। কোভিড পরিস্থিতির জন্য এবার নিরঞ্জন করতে তাদের প্রতিমা বাবুঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়নি। পরিবর্তে মণ্ডপ চত্বরে ২০ ফুট লম্বা ও চওড়া কৃত্রিম জলাধার তৈরি করা হয় পুজো কমিটির তরফে। সেখানেই প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। পুজো উদ্যোক্তাদের অন্যতম লাল্টু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আমাদের প্রতিমা বিসর্জনে বহু লোকের সমাগম হয়। তাই এই পরিস্থিতিতে এ ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় ছিল না।’ উল্লেখ্য, এই পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা হলেন কলকাতা পুরসভার প্রশাসক মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য দেবাশিস কুমার। বিসর্জনের এই অভিনব রীতি তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত বলে জানা গিয়েছে।
এদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় তৃণমূল সাংসদ তথা অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তীর একটি ছবি ভাইরাল হয়। বিজয়া দশমীতে ঢাকের তালে ধুনুচি নাচে সবাইকে মাতিয়ে দেন তিনি। সেই সঙ্গে তিনি সবাইকে বিজয়ার শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন। তবে এদিন কলকাতার অনেক বারোয়ারি পুজোর প্রতিমা নিরঞ্জন হয়নি। যে সব মণ্ডপে এখনও প্রতিমা থেকে গিয়েছে, সেগুলিতে এদিনও অনেক দর্শনার্থীকে কোভিড বিধি মেনে প্রতিমা দর্শন করতে দেখা যায়। চেতলা অগ্রণীর পুজোয় অনেক দর্শককে এদিন রাতে দেখা গিয়েছে। যদিও অন্যান্য বারের তুলনায় এবারের দর্শকসংখ্যা যথেষ্ট কম।
এদিন বিকেলে নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়ার পর নিরঞ্জনে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিমা। কলকাতারই কলুটোলার বদনচন্দ্র রায়ের বাড়ির প্রতিমাও এদিন নিরঞ্জন হয়েছে। তার পরই এই বাড়িতে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া। প্রতিমা নিরঞ্জন হয়েছে হাটখোলার দত্তবাড়িরও। ভবানীপুরের পদ্মপুকুর রোডের মিত্র বাড়িতে বিসর্জনের আগে গৃহকর্ত্রী তাঁর মাথার চুল প্রতিটি প্রতিমার পায়ে বেঁধে দেন। প্রতিমা নিরঞ্জিত হয় মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের শীলবাড়িরও। তবে নিরঞ্জনের পর এই বাড়িতে বিষাদ নয়, শুরু হয়ে যায় নতুন এক কর্মব্যস্ততা। আসলে মঙ্গলবার এই বাড়িতে বসছে প্রীতিভোজের আসর।
আবার, ৩০০ বছর ধরে চলছে একই রীতি। আসানসোল শিল্পাঞ্চলের কুলটির নিয়ামতপুরের বেলরুই গ্রামের জমিদার রায় পরিবারের পুজোয় দশমীতে গান স্যালুট দিয়ে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানানো হয়। রায় পরিবারের সদস্যদের অধিকাংশই পেশাগত কারণে বিদেশে থাকেন। কিন্তু পুজোর সময় অধিকাংশ সদস্যই এসে হাজির হন বাড়িতে। শুরু থেকেই এই রায় বাড়ির পুজো দেখতে দূর–দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসতেন। নিয়ম অনুযায়ী দুর্গাপুজোর ঘট বিসর্জনের পর মাকে বিদায় জানানো হয় গান স্যালুটে। সোমবার এই রীতি প্রত্যক্ষ করতে বেলরুই গ্রামের বহু মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
আরেকটি অভিনব অথচ চিরাচরিত দৃশ্য দেখা যায় জলপাইগুড়ির বৈকণ্ঠপুরের রাজবাড়িতে। পুজোর বয়স ৫১১ বছর। রাজবাড়ির এই পুজোর প্রাচীন রীতি হল, পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছের মুড়ো দিয়ে কচুশাক আর শাপলার তরকারি খেয়ে রাজবাড়ি থেকে উমা পাড়ি দেন কৈলাসে শ্বশুর বাড়িতে। সোমবার এই রীতি মেনে পরিবারের সদস্যরা দুর্গার মুখ দেখেন তামার পাত্রে। এর পর তোপধ্বনি করা হয়। তখনই সূচনা হয় বিসর্জন পর্বের। করোনা আবহে সমস্ত নিয়ম মেনে শূন্যে গুলি ছুঁড়ে শুরু হয় বিসর্জনের প্রস্তুতি। ঢাকের বোলে চলতে থাকে বিসর্জনের নিয়ম পালন। প্রত্যক্ষ করেন বহু মানুষ।
অন্যদিকে, প্রতিমা বিসর্জনে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে মুর্শিদাবাদে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার ডুমরিদহ বিল এলাকায় প্রতিমা বিসর্জন দিতে গিয়ে দুটি নৌকো ধাক্কা খেয়ে ডুবে গেলে নিখোঁজ হন পাঁচজন। চারজনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। একজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি এখন ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন।