বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: পুরো নভেম্বর মাসটাই দার্জিলিংয়ে কাটাবেন পশ্চিমবাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। আর সেই ঘটনা নিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। এর আগেও তিনি দার্জিলিংয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দিন কয়েকের বেশি সেখানে থাকেননি। সাধারণত রাজ্যপালরা সেখানে গিয়ে দিন কয়েকই থাকেন। ফের কলকাতায় ফিরে আসেন। তাই বিষয়টির পেছনে অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। আবার, অনেকের বক্তব্য, দার্জিলিংয়ে দীর্ঘসময় কাটানোর ঘটনা রাজ্যে একেবারেই যে নজিরবিহীন, তা নয়। তাই ঘটনাটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা অর্থহীন বলেই তাঁরা মনে করছেন।
অবশ্য উৎসবের মরশুমে প্রথমে দিল্লি সফরে যাওয়ার কথা ছিল বাংলার সাংবিধানিক প্রধানের। সেই সূচি অনুযায়ী বুধবার বিকেলেই দিল্লি চলে যান তিনি। সেখানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকেরও কথা রয়েছে তাঁর। দিল্লি থেকে ফিরে একদিন বিশ্রাম নিয়েই দার্জিলিংয়ে চলে যাবেন। তার পর গোটা নভেম্বর মাসটাই সেখানে থাকবেন। অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক এবং পাহাড়ে গোটা মাস কাটানোর সিদ্ধান্ত যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে ধারণা তথ্যাভিজ্ঞ মহলের। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে রাজ্যপালেরই একটি টুইটে। সেখানে তিনি লেখেন, ২৮ অক্টোবর সরকারি সফরে দিল্লি যাচ্ছেন। থাকবেন ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত। ২৯ অক্টোবর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তবে বৈঠকের বিষয় নিয়ে কোনও কথা লেখেননি তিনি। কিন্তু বৈঠকে কোন বিষয়ে আলোচনা হয়, সেদিকে নজর রয়েছে রাজ্যের রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের।
রাজভবন সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার বিকেলের বিমানে তিনি কলকাতা থেকে দিল্লি চলে যান। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে কী বিষয়ে আলোচনা হবে, তা নিয়ে রাজ্যপাল যেমন কোনও ইঙ্গিত দেননি, রাজভবনও তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানায়নি। সূত্রের খবর, রাজ্যের আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলোচনা হবে। পাশাপাশি রাজ্যের আমলাদের আচরণ নিয়েও অমিত শাহকে রিপোর্ট দেবেন তিনি। এর কারণ হিসেবে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, গত এক বছর ধরে রাজ্যের ডিজি থেকে শুরু করে শীর্ষ আমলাদের ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ্যেই রাজ্যপাল নানা প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের আচরণ যে ঠিক নয়, সে কথাও ক্ষোভের সঙ্গে জানিয়েছেন। সে সব কথা এবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিস্তারিত ভাবে জানাতে পারেন। এ ছাড়া, রাজ্যপালের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাজ্যের সঙ্গে বারবার সঙ্ঘাতে জড়িয়েছেন জগদীপ ধনকড়। কখনও বাংলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সরব হয়েছেন, আবার কখনও শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে রাজ্য সরকারকে তুলোধনা করেছেন। যদিও পালটা আবার তাঁর বিরুদ্ধে অতিসক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছে রাজ্য সরকারও।
৩০ অক্টোবর কলকাতায় ফেরার পর একদিন রাজভবনেই থাকবেন। তার পর দার্জিলিং চলে যাবেন। টানা একমাস সেখানে থাকবেন তিনি। কিন্তু এই একমাস সেখানে তিনি কী করবেন, তা জানতে কৌতূহল রয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন মহলের। কারণ, রাজ্যপাল বিশ্রামের জন্য যে দার্জিলিং যাচ্ছেন না, টুইটের বক্তব্যেই তা পরিষ্কার। আর এক মাস ধরে তিনি দার্জিলিংয়ে হাত–পা গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা হতে পারে না। মনে করা হচ্ছে, বিমল গুরুংয়ের দার্জিলিংয়ে ফেরার ঘটনা নিয়ে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পাহাড়। তাই সেই সময়টা পাহাড়ে থেকে পরিস্থিতি যাচাই করতে পারেন। উল্লেখ্য, বিমল গুরুংয়ের গোর্খাল্যান্ড নিয়ে আন্দোলনে হিংসা ছড়ায় পাহাড়ে। সেই সময় গুরুংপন্থীদের হামলায় প্রাণ হারান পুলিশ অফিসার অমিতাভ মালিক। সেই সময় বিমল গুরুংয়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। গুরুংও তখন সদলে ফেরার হয়ে যান। অমিতাভ মালিকের মৃত্যুর ঘটনায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, বিমল গুরুং উপযুক্ত শাস্তি পাবেনই।
সেই বিমল গুরুংই কয়েকদিন আগে দুর্গাপুজোর পঞ্চমীর দিন আচমকা কলকাতায় হাজির হন। শুধু তাই নয়, বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ এবং তৃণমূলকে সমর্থনের কথা জানান। যদিও এই ঘটনা নিয়ে তৃণমূল অতি সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানায়। বিজেপির সঙ্গ ছাড়ার জন্য বিমল গুরুংয়ের প্রশংসাও করা হয়। সূত্রের খবর, পাহাড়ের রাজনীতির কর্তৃত্ব ফিরে পেতে বিমল গুরুংকে তৃণমূলের দিকে টেনে আনার চেষ্টা চলছিল শাসক দলের তরফেই। গুরুং ফেরার পুরো ঘটনাটির পেছনে শাসক দলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোরের তৎপরতা রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। স্বভাবতই নিহত পুলিশ অফিসার অমিতাভ মালিকের বাবা প্রশ্ন তোলেন, তাঁর ছেলের খুনের পেছনে যিনি দায়ী, তিনি মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন? তাঁকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন? এ ছাড়া, বিমল গুরুং ফিরতেই জিটিএ–র প্রধান বিনয় তামাং গোষ্ঠীও ক্ষোভ গোপন রাখেনি। তারা এতদিন শাসক দল তৃণমূলের পক্ষে থাকলেও এখন বেসুরো গাইতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে পাহাড়ের রাজনীতি ফের তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
এমতাবস্থায় রাজ্যপালের টানা একমাস পাহাড়ে থাকার সিদ্ধান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ একাংশের ধারণা, এই পরিস্থিতিতে পাহাড়ের রাজনীতি কোন দিকে রয়েছে, তা যাচাই করে দেখতে পারেন তিনি। যদিও তাঁরা মনে করছেন, তাতে লাভ হবে না। পাহাড়ে এবার বিজেপি কিছুই করতে পারবে না। রাজনৈতিক সমস্ত সুবিধা তৃণমূলই পাবে। এমন অবস্থায় রাজ্য বিজেপি সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলছে। রাজ্যপালের সফর নিয়ে তারা স্বাভাবিক ভাবেই মুখ খোলেনি। কিন্তু রাজ্যের সচেতন অংশের ধারণা, এতদিন পাহাড় শান্ত বলে কৃতিত্বের দাবি করতেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। এবার রাজনৈতিক স্বার্থে পাহাড়ে অশান্তি ফিরিয়ে আনছে তাঁর দল তৃণমূলই। তাই রাজনৈতিক মহলের ধারণা, এই পরিস্থিতিতে রাজ্যপালের পাহাড়ে গিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ।