বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: আইন–শৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতি হয়েছে বাংলায়। নৈরাজ্য চলছে এই রাজ্যে। প্রশাসনিক আমলারা রাজনৈতিক ভৃত্যে পরিণত হয়েছেন। দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলন করে রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে এমনই বিস্ফোরক অভিযোগ করেছেন পশ্চিমবাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। অবশ্য তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনের পর মুখ খুলেছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল। তারাও চাঁছাছোলা ভাষায় সমালোচনা করেছে রাজ্যপালের। তাঁর ভূমিকার সমালোচনা করেছে কংগ্রেস এবং সিপিএমও।
বৃহস্পতিবার দিল্লিতে সাংবাদিকদের রাজ্যপাল বলেন, ‘বাংলায় এখন আইন–শৃঙ্খলা বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। ভয়ঙ্কর নৈরাজ্য চলছে এই রাজ্যে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এখন পুলিশ দিয়ে শাসনকাজ চালাচ্ছেন। নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক খুন, জখম, হানাহানির ঘটনা। পশ্চিমবাংলায় যা হচ্ছে, তা সংবিধানে উল্লেখ করা গণতন্ত্রের ঠিক বিপরীত কাজ।’ রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাদের ভূমিকারও তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। বলেন, ‘রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তারা এখন রাজনৈতিক কর্মীদের মতো আচরণ করছেন। আমলারা রাজনৈতিক দলের অনুগত হয়ে কাজ করছেন। মুখ্যসচিব, নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। ফলে রাজ্যের আইন–শৃঙ্খলা একেবারে ভেঙে পড়েছে। প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। গণতন্ত্র বলে কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেই রাজ্যে। তাই যে কোনও বিষয়েই প্রশাসনকে চিঠি লিখি না কেন, প্রশাসন তার কোনও জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।’
এদিন তিনি আরও বলেন, ‘আমি সমালোচনায় বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি পুনর্গঠনে। রাজ্য জুড়ে রাজনৈতিক কারণে হিংসার ঘটনা বেড়েই চলেছে। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ করার বদলে প্রশাসন ঘুমিয়ে রয়েছে। আমি চাই রাজ্যের উন্নতি হোক। আর সেই উন্নতি কাজের মাধ্যমেই হতে পারে। দেশের সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের জানা উচিত বাংলার এই নৈরাজ্যের কথা।’ তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘এই রাজ্যে সুষ্ঠুভাবে কী করে ভোট করানো হবে, তা নিয়ে আমি রীতিমতো উদ্বিগ্ন। পশ্চিমবাংলায় স্বাধীন ও ভয়মুক্ত নির্বাচন যাতে করানো যায়, তা আমি নিশ্চিত করতে চাই।’ সূত্রের খবর, আগামী বছরেই রাজ্যে বিধানসভা ভোট। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে আদৌ সুষ্ঠুভাবে ভোট সম্ভব কিনা, বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে সেই সমস্ত কথাই তিনি জানিয়েছেন। শুক্রবারই রাজ্যপাল কলকাতায় ফিরছেন। তার পর ১ নভেম্বর তিনি দার্জিলিং চলে যাচ্ছেন। সেখানে টানা একমাস থাকবেন। সেই ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা চলছে। বিশেষ করে শাসদ দল তৃণমূলের তরফে রাজ্যপালের পাহাড় সফরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে।
দিল্লিতে রাজ্যপালের এই সাংবাদিক সম্মেলনের পরই কলকাতায় মুখ খোলে তৃণমূল। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে মন্তব্য করার আগে তাঁর দেখা উচিত ছিল উত্তরপ্রদেশের অবস্থা। উত্তরপ্রদেশে গণতন্ত্র লঙ্ঘিত হচ্ছে। সেই বিষয়ে তিনি মুখ খুলছেন না কেন? পশ্চিমবঙ্গে আইনের শাসন আছে বলেই এখানে গণতন্ত্র বেঁচে আছে। রাজ্যপাল যেভাবে রাজনৈতিক মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন, তাতে তাঁর আসল উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে।’ তবে রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, তৃণমূল মহাসচিবের যুক্তিতে ধার নেই। জগদীপ ধনকড় বাংলার রাজ্যপাল। তাই বাংলার বিষয়েই তিনি মন্তব্য করতে পারেন। উত্তরপ্রদেশের পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করতে হলে করবেন সেই রাজ্যের রাজ্যপাল আনন্দীবেন প্যাটেল। শুধু পার্থ চট্টোপাধ্যায়ই নন, মুখ খুলেছেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ও। তিনি বলেছেন, ‘রাজ্যপাল বিজেপির রাজনৈতিক মুখপাত্র হয়ে উঠতে চাইছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যপালের যে বৈঠক হবে, তা হওয়া উচিত কনফিডেন্সিয়াল। তা রাজ্যপাল কী করে বলে দিচ্ছেন? এইজন্যই তো রাজ্যপালকেই সরিয়ে দেওয়া উচিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।’ রাজ্যপালের সমালোচনা করেছেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
দিল্লিতে সাংবাদিকদের যে সব কথা বলেছেন রাজ্যপাল, সেই প্রসঙ্গে মুখ খুলেছে বিজেপিও। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘রাজ্যপাল কোনও কথা বাড়িয়ে বলেননি। একেবারে ঠিক কথাই বলেছেন। তিনি সাধারণ মানুষের মনের কথাই বলেছেন। তৃণমূল নেতারা তা যে মানতে চাইবেন না, তা তো সত্যি কথাই। কারণ, তাঁরা এখন মানুষের কথা শুনতে চান না। মানুষের কথার কোনও গুরুত্ব আজ তাঁদের কাছে নেই। বাংলার পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ থেকে অতি খারাপের দিকে এগোচ্ছে। এইসব কথা বাংলার বাইরের মানুষের জানা উচিত। তাই তিনি দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে এ কথা বলেছেন। এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের নীতিই হল বিরোধীদের পুরো ধ্বংস করে দিয়ে রাজনীতি করা। আর সরকারি আধিকারিক ও পুলিশ তাদের সেই কাজে পুরোপুরি মদত দিয়ে চলেছে।’ বিজেপি নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন, ‘গণতন্ত্র, আইন–শৃঙ্খলা ও রাজ্যের শান্তির দিকে তাকিয়ে রাজ্যপাল সম্পূর্ণ ঠিক কথাই বলেছেন। তাঁর মন্তব্য নিয়ে যাঁরা বিতর্ক তৈরি করতে চাইছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ঠিক নয়। তাঁদের মনে রাখা উচিত, রাজ্যপাল সংবিধানের রক্ষক। রাজ্যপাল সাধারণ মানুষের মুখপাত্র, কোনও রাজনৈতিক দলের নন।’
বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে পিছিয়ে থাকেনি রাজ্যের কংগ্রেসও। দলের নেতা তথা রাজ্যসভার সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘রাজ্যপালের মতামত পক্ষপাত দুষ্ট হওয়া উচিত নয়। তবে নিজের আওতার বাইরে গিয়ে রাজ্যপালের মন্তব্য করার সাংবিধানিক নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে রিপোর্ট দেওয়ার আগে রাজ্যপালের উচিত ছিল তা নিয়ে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব, মুখ্যসচিব ও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করা। তিনি তা করেছিলেন কিনা, তা আমার জানা নেই।’ রাজনৈতিক মহলের মতে, রাজ্যের বর্তমান রাজ্যপাল প্রচলিত পথে চলেন না। কারণ, তিনি জানেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে আমলাদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে তিনি কোনও রকম সাহায্য পাবেন না।
অন্যদিকে, তৃণমূলের মতোই কথা শোনা গিয়েছে বামফ্রন্টের কাছ থেকে। বাম চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, ‘উত্তরপ্রদেশের গণতন্ত্র নিয়ে তিনি কোনও কথা বলছেন না কেন? বাংলা সম্বন্ধে কিছু বলার আগে তাঁর উত্তরপ্রদেশ সম্পর্কেও কিছু বলা উচিত ছিল।’ সিপিএম নেতা শমীক লাহিড়ী বলেছেন, ‘রাজ্যপাল তাঁর পদের মর্যাদা দিতে জানেন না। সব সময় তিনি রাজনৈতিক কাজই করে যাচ্ছেন।’