বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা:শেষ অবধি বামেদের ঘরে ভাঙন ধরিয়েই দিল বিজেপি। সিপিএমের দাপুটে নেত্রী তথা কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর, বর্তমানে ওয়ার্ড কো–অর্ডিনেটর রিঙ্কু নস্কর মঙ্গলবার সদলবলে যোগ দিলেন বিজেপিতে। কলকাতার হেস্টিংস অফিসে রিঙ্কুর হাতে দলের পতাকা তুলে দেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। নীতি–আদর্শ সর্বস্ব একটি বামপন্থী দল থেকে বিজেপিতে যোগদানের ঘটনায় পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। ঘটনায় অস্বস্তিতে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। যদিও কংগ্রেস ও সিপিএম অন্যের ঘর ভাঙানোর জন্য তৃণমূল ও বিজেপির তীব্র সমালোচনা করেছে।
অবশ্য রিঙ্কু নস্করকে হারাতে চাননি সিপিএম নেতারা। রিঙ্কু বিজেপিতে যেতে পারেন, এমন খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই সিপিএম নেতারা তৎপর হয়ে ওঠেন। অনেক বোঝান তাঁকে। কিন্তু কোনও তৎপরতাই রিঙ্কু দেবীকে প্রভাবিত করতে পারেনি। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগে রিঙ্কু বলেন, ‘এখন আবার কেউ নীতি–আদর্শ মেনে চলে নাকি? যদি নীতি–আদর্শকে সবাই গুরুত্ব দিত, তা হলে কংগ্রেস আর সিপিএমের জোট হত না। আমি এই জোট মানতে পারছি না। তাই কর্মী–সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর এদিন সন্ধ্যায় তিনি বলেন, ‘বাংলা থেকে তৃণমূলের অপশাসনের অবসান ঘটাতে পারে একমাত্র বিজেপিই। বিজেপি ছাড়া এখন অন্য আর কোনও রাস্তা নেই। তা ছাড়া সাধারণ মানুষ এখন বিজেপির পক্ষেই কথা বলছে। সাধারণ মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেব না তো ভোটের জন্য জোট করাকে গুরুত্ব দেব! অনেক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিজেপির আদর্শকে আমি বিশ্বাস করি। এই দল তৈরি হয়েছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আদর্শে।’
রাজ্যে সিপিএমের লড়াকু নেত্রী হিসেবেই রিঙ্কু পরিচিত। দলের মধ্যে যুব নেত্রী হিসেবে তাঁর বেশ নামডাক ছিল। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর কেন্দ্র থেকে রিঙ্কুকে প্রার্থী করেছিল সিপিএম। নির্বাচনে জিততে না পারলেও তিনি বহু মানুষের সমর্থন যেমন পেয়েছিলেন, তেমনই একটা আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন নির্বাচনী প্রচারে। তৃণমূলের দাপটের সামনে মাথা নত না করে ২০১৫ সালে কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে যাদবপুরে ১০২ নং ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছিলেন। রিঙ্কুর স্বামী মানস মুখোপাধ্যায় কিছুদিন আগে বিজেপিতে যোগ দেন। তার পর থেকেই বিজেপির সঙ্গে রিঙ্কুর যোগাযোগ বাড়তে থাকে বলে কানাঘুঁষো চলছিল। তবে জানা গিয়েছে, স্বামী নন, বর্তমানে বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি মুকুল রায়ের হাত ধরেই বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় রিঙ্কু দেবীর। উল্লেখ্য, মানস মুখোপাধ্যায় গত শতকের সাতের দশকে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রিঙ্কুর সঙ্গে এদিন বহু সিপিএম কর্মী–সমর্থকও বিজেপিতে যোগ দেন। পরে তৎপর্যপূর্ণ ভাবে দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘যাঁদের কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে, কিন্তু অন্য দলে থেকে কাজ করতে পারছেন না, হাঁপিয়ে উঠেছেন, তাঁদের সকলের জন্য বিজেপির দরজা খোলা রয়েছে।’
এই ঘটনা কংগ্রেস বা সিপিএম যে মেনে নিতে পারবে না, সে কথা বলাই বাহুল্য। এদিন দলবদল প্রসঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি এবং বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু তৃণমূল এবং বিজেপিকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। যদিও রিঙ্কু নস্করের নাম তাঁরা সরাসরি উচ্চারণ করেননি। এদিন বিকেলে প্রদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে বৈঠক ছিল বামফ্রন্টের। বৈঠক শেষে কলকাতার ক্রান্তি প্রেসে প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরি বলেন, ‘বাম–কংগ্রেস জোটের সম্ভাবনা বাড়ছে। তাই তৃণমূল এবং বিজেপি এই জোটের ঘর ভাঙাতে টাস্ক দিচ্ছে।’ উল্লেখ্য, কয়েকদিন আগে বসিরহাটের কংগ্রেস বিধায়ক যোগ দেন তৃণমূলে। সেই সময়ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছিলেন অধীর। এদিনও তিনি বলেন, ‘বাম ও কংগ্রেসের বর্তমান ও প্রাক্তন বিধায়কদের প্রশান্ত কিশোরের টিম তৃণমূলে টানার চেষ্টা করছে বলে শোনা যাচ্ছে। বিজেপির তরফেও একই কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে অনেকে বলছেন। আসলে এই জোটকে তারা ভয় পেয়ে গিয়েছে।’
অন্যদিকে, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, ‘কেউ কেউ ভাবছেন, শুধু বিজেপিই বিপদ। এ কথা ঠিক, দেশের সামনে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে এখন বিজেপি একটা বড় বিপদ। কিন্তু, এই রাজ্যে বিজেপিকে হাত ধরে এনেছিল এই তৃণমূলই। তৃণমূলও রাজ্যের ক্ষেত্রে কম বিপজ্জনক নয়। তাই এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে বাম–কংগ্রেস যৌথ ভাবে লড়াই করবে।’ তবে এদিন রিঙ্কুকে সিপিএমে আটকে রাখার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর মুখ খোলেন সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী। কোনও রকম রাখঢাক না করেই তিনি বলেন, ‘বড় হয়েছেন। বয়স হয়েছে। তাই স্বাধীন সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। আসলে তিনি স্বামীর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন।’ এদিকে, বিজেপি সূত্রে খবর, সিপিএমের আরও কয়েকজন নেতা ও নেত্রী বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন। সময় হলেই তাঁরা বিজেপিতে যোগ দেবেন।