বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা: নন্দীগ্রাম দিবসে তৃণমূলের দাপুটে নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর সভার পরই শ্রীরামপুর টাউন হল থেকে তাঁর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন দলেরই সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শালীনতার সীমা অতিক্রম করে তিনি বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকলে শুভেন্দু অধিকারী নাকি কলকাতা পুরসভার সামনে আলু বিক্রি করতেন। নিজের বাবা শিশির অধিকারীর সৌজন্যেই নাকি শুভেন্দুর উত্থান। হুগলির বলাগড়ে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই সমালোচনারই পাল্টা জবাব শুভেন্দু দিলেন শুক্রবার। যদিও তা দিলেন যথেষ্ট পরিশীলিত ভাষায় এবং নাম না করেই।
সেই সঙ্গে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই সমালোচনা প্রসঙ্গে হুগলির মানুষের মত কী, তাঁরা তা সমর্থন করেন কিনা, তা–ও জেনে নেন। হুগলির মাটিতে দাঁড়িয়ে যে ভাবে শুভেন্দু এদিন কল্যাণকে পাল্টা আক্রমণ করে গেলেন, তা যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। এদিন বলাগড়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে শুভেন্দু বলেন, ‘প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ অনিল বসু যখন কারও বিরুদ্ধে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করতেন, আমি জানি হুগলি জেলার মানুষ সেই ভাষাকে গ্রহণ করেননি। আর সেই ভাবে আজও যদি কোনও জনপ্রতিনিধি শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করে আমাকে অথবা আমার পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন, বলুন, আপনারা কি তা সমর্থন করবেন? মেনে নেবেন?’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, সেই সময় উপস্থিত জনতা রীতিমতো চিৎকার করে জানিয়ে দেয়, তারা শুভেন্দুর পাশে আছে এবং তাঁকেই সমর্থন করছে। ঘটনাটি যে শুধু তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নয়, দল হিসেবে তৃণমূলকেও যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ওইদিন শ্রীরামপুরে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় রীতিমতো ‘তুই–তুকারি’ করে শুভেন্দু অধিকারীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে গাছের ছায়ায় বড় হয়েছিস। চারটে মন্ত্রিত্ব, চারটে চেয়ার পেয়েছিস। আর কত চাই? কত পেট্রোল পাম্প বানিয়েছিস? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকলে এ সব করা সম্ভব হত না। হিম্মত থাকে তো দল ছেড়ে চলে গিয়ে দেখা।’ শুক্রবার কল্যাণের সেই অশালীন আক্রমণের জবাবে উপস্থিত জনতাকে শুভেন্দু আরও বলেছেন, ‘আপনারা কি এই কালচার সমর্থন করেন?’ জনতাও চিৎকার করে জানায়, ‘না।’ শুভেন্দুর এই বক্তব্যের পরই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তৃণমূলের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে যখন তাঁর আলোচনা চলছে, তখন এমন বক্তব্য পেশের মধ্য দিয়ে তিনি দলকে চাপের মধ্যে রাখার পথ নিয়েছেন। উল্লেখ্য, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অশালীন ভাষা নিয়ে ইতিমধ্যেই তৃণমূলের অভ্যন্তরেই সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। একজন শিক্ষিত সাংসদের মুখের ভাষা কী করে এমন হতে পারে, তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলেন।
বৃহস্পতিবার রামনগরে শুভেন্দুর সভার পরই কল্যাণ নিজের বক্তব্য থেকে সরে আসেন। বলেন, ‘শিশির অধিকারী আমার পিতৃস্থানীয়। তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। অধিকারী পরিবারের প্রত্যেকের প্রতি আমার ভালবাসা রয়েছে। শুভেন্দু অধিকারীর প্রতিটি কথাকে আমি স্বাগত জানাচ্ছি। আমি খুব খুশি।’ ওইদিন রামনগরের সভায় শুভেন্দু বলেছিলেন, ‘আমি এখনও দলের প্রাথমিক সদস্য। রাজ্য মন্ত্রিসভারও সদস্য। দলের নিয়ন্ত্রকরা আমাকে তাড়াননি। আমিও দল ছাড়িনি। মুখ্যমন্ত্রী আমায় মন্ত্রিসভা থেকে তাড়িয়ে দেননি। আমিও ছাড়িনি। যে ক’টি পদে আছি, সব কটিতেই আমি নির্বাচিত। মন্ত্রিসভায় থেকে দলের বিরুদ্ধে আমি কথা বলব না। আমরা বিদ্যাসাগরের দেশের মানুষ। আমরা এত অনৈতিক কাজ করি না।’ কিন্তু শুক্রবার শুভেন্দুর সমালোচনার পর কল্যাণ ফের সরব হন। বলেন, ‘দলে থেকে যদি দলের কোনও জনপ্রতিনিধির সমালোচনা কেউ করেন, তা হলে বুঝতে হবে, তাঁর সঙ্গে অন্য দলের কোনও আঁতাত হয়েছে।’
যদিও কল্যাণের এই বক্তব্যের পর শুভেন্দু–কল্যাণ বিতর্ক আরও জটিল হতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে তৃণমূল শিবিরে এখন দু’রকম মত পাওয়া যাচ্ছে। এক পক্ষ শুভেন্দু সম্পর্কে নমনীয় বক্তব্য পেশ করছেন তো অপর পক্ষ শুভেন্দুকে আক্রমণ করছেন। যেমন শুভেন্দু সম্পর্কে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘শুভেন্দু অধিকারী এখনও আমাদের সহযোদ্ধা।’ তবে বিষয়টি নিয়ে এবার মুখ খুলেছে সিপিএমও। দলের নেতা সুজন চক্রবর্তী শুক্রবার কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘পিসি–ভাইপোর দলে অন্য আর কারও কোনও মর্যাদা নেই। এতদিন যে কটি মই বেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপরে উঠেছেন, সেইসব মই–ই তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। এটাই বরাবর করে এসেছেন তিনি।’ যদিও সুজন চক্রবর্তীর এই মন্তব্যের জবাবে তৃণমূলের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি।