বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা:শুভেন্দু অধিকারী কি তা হলে সত্যিই বিজেপিতে যাচ্ছেন? কলকাতা জুড়ে রবিবার দিনভর এ নিয়েই চর্চা চলে রাজনৈতিক মহলে। বিশেষ করে বিজেপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলার পরই শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে রাজনৈতিক জল্পনা অন্য রকম গুরুত্ব পেয়ে যায় শুধু কলকাতা নয়, পশ্চিমবাংলা জুড়েই। তবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ অবশ্য সতর্কতার সঙ্গে বলেছেন, ‘শুভেন্দু অধিকারী কী করবেন তা আমার জানা নেই।’ অবশ্য বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় সরাসরি বলেছেন, ‘শুভেন্দুর জন্য বিজেপির দরজা খোলা। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে এলে তাঁকে স্বাগত জানাব।’
শনিবারই এই জল্পনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং। তিনি জানান, শুভেন্দু অধিকারী, সৌগত রায়–সহ ৫ জন তৃণমূল সাংসদ নাকি বিজেপিতে যোগ দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে সৌগত রায়ও পাল্টা জবাব দেন, মরে গেলেও তিনি বিজেপিতে যাবেন না। ঠিক একই সময়ে বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় জানান, তৃণমূলের শীর্ষ সারির অনেক নেতাই বিজেপিতে আসতে চান। তাঁরা নিয়মিত হোয়াটসঅ্যাপ কলের মাধ্যমে বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। বলা বাহুল্য, বিজেপি নেতা ও নেত্রীদের এমন বক্তব্য তৃণমূল নেতৃত্বের স্নায়ুর চাপ অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু শুভেন্দু সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা যে মন্তব্য করলেন, তা প্রকাশ্যে মেনে না নিলেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে তৃণমূল নেতাদের পক্ষে। অবশেষে শুভেন্দুকে নিয়ে মুখ খুলে ইঙ্গিতবহ মন্তব্য করেন বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক তথা পশ্চিমবঙ্গের পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। তিনি বলেন, ‘শুভেন্দুর দলত্যাগ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।’ আর এ কথা তিনি বলেছেন শুভেন্দুর খাসতালুক পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরে। ফলে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে শুভেন্দু–বিতর্ক অন্যমাত্রা পেয়ে যায়।
শুধু শুভেন্দু বিষয়েই নয়, তৃণমূল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করে কৈলাস বলেছেন, ‘দিদির আত্মবিশ্বাস এখন পুরোপুরি হারিয়ে গিয়েছে। তাই এখন নেতাদের ওপর নয়, একটা সংস্থার ওপর তিনি নির্ভর করছেন। তাও আবার সেটা একটা বহিরাগত ভুয়ো সংস্থা। সেই সংস্থাকে তিনি দল চালানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। ভাবুন অবস্থাটা। তৃণমূল এখন আর দিদির পার্টি নয়, মুকুল রায়ের পার্টি নয়, শুভেন্দুরও পার্টি নয়। এখন দলটা একটা সংস্থার অধীন। তাই তো শুভেন্দুও এখন তৃণমূল দলটাকেই বিদায় জানাতে তৈরি হয়ে গিয়েছেন।’ যেহেতু শুভেন্দু সম্পর্কে বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক ওই মন্তব্য করেছেন, তাই সেই মন্তব্য ফাঁকা আওয়াজ বলে উড়িয়ে দিতে পারছে না তৃণমূলও। বুঝতে পেরে বিষয়টি নিয়ে সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘বিজেপির উৎসাহই বলে দিচ্ছে কার, কোথায় যোগাযোগ রয়েছে।’ তবে শুভেন্দুর বাবা তথা তৃণমূলের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সভাপতি শিশির অধিকারী স্পষ্ট বলেছেন, ‘বিধানসভা ভোটের আগে শুভেন্দুর নাম ভাঙিয়ে কেল্লাফতে করতে চাইছে বিজেপি। শুভেন্দু নিজের মুখে নিজের অবস্থান জনসমক্ষে জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে আমি কিছু বলব না।’
সূত্রের খবর, কৈলাসের বক্তব্য প্রকাশ্যে আসার পরই বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের অভ্যন্তরেই তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। শুভেন্দুকে কী করে আটকানো যায়, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলের শীর্ষস্তরের নেতাদের নিয়ে তাঁর বাড়িতে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, শুভেন্দু অধিকারী নিজে দলত্যাগ না করলে দল তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবে না। এমনকী, নিয়মিত দলবিরোধী মন্তব্য করে গেলেও তাঁকে কোনও ভাবেই বহিষ্কার করা হবে না। কিন্তু দলের অন্য নেতাদের দিয়ে ক্রমাগত আক্রমণ করে তাঁকে দলের মধ্যেই কোনঠাসা করে ফেলা হবে। শুধু তাই নয়, একটা একটা করে মন্ত্রিত্ব ও অন্যান্য পদ থেকেও তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে। এ ভাবে দলের মধ্যেই তাঁকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করে ফেলতে হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ধারাবাহিক ভাবে আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছেন শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে।
এদিনও শুভেন্দুর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘বিজেপি নেতারা যা বলছেন, তা যদি মিথ্যে হয়, তা হলে শুভেন্দুরই প্রতিবাদ করা উচিত। তিনি কিন্তু তা করছেন না। এর মানে সেই মন্তব্যে তাঁর সমর্থন রয়েছে।’ শুভেন্দুকে নিয়ে তৃণমূল যে চিন্তিত, তার প্রমাণ রবিবার পাওয়া গিয়েছে শোভন চট্টোপাধ্যায় ইস্যুতে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একটি কথায়। উল্লেখ্য, বেশ কিছুদিন হল শোভন চট্টোপাধ্যায় তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু বিজেপির রাজ্য নেতাদের একাংশের সঙ্গে তাঁর বনিবনা না হওয়ায় তাঁকে ঘিরে জটিলতা বাড়ছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সেই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়েছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। শোনা যাচ্ছে, শোভন নাকি এখন অনেকটাই নমনীয়। এমতাবস্থায় মনে করা হচ্ছে, শোভন চট্টোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত বিজেপিতেই থিতু হতে যাচ্ছেন। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, সেই সম্ভাবনা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
এখন শোভনবাবু যদি বিজেপির হয়েই রাজনীতির ময়দানে নামেন, তা হলে তৃণমূলের সমস্যা হবে কিনা, রবিবার জানতে চাওয়া হলে সাংবাদিকদের পার্থ বলেন, ‘অনেকেরই থাকা, না–থাকা দোদুল্যমান। আমাদের অসুবিধা তখনই হবে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থাকবেন না। রাজনীতির ময়দানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া কার দৌড় কতখানি, তা আমাদের জানা আছে। রাজনৈতিকভাবে আমরা শক্তিশালী, কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের মাথায় রয়েছেন।’ কিন্তু এদিন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায় বিজেপির দাবি অন্য মাত্রা পেয়ে গেল বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।