বিশেষ প্রতিনিধি,কলকাতা: মান–অভিমান ভুলে শেষ পর্যন্ত কি তৃণমূলেই থেকে যাচ্ছেন শুভেন্দু অধিকারী? ফিরে যাবেন মন্ত্রিত্বে? পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচ্য প্রশ্ন এখন এটাই। উত্তর কারও জানা নেই। তবে সৌগত রায়ের দাবি, থাকছেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ম্যারাথন বৈঠক নাকি ইতিবাচক হয়েছে। তবে সেই বৈঠক নিয়ে মুখ খোলেননি শুভেন্দু।
উত্তর কলকাতার একটি বাড়িতে এদিন সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ শুভেন্দু–অভিষেকের ম্যারাথন বৈঠক শুরু হয়। রাজনৈতিক মহলের মতে, অভিষেকের সঙ্গেই বিরোধের জের আজকের এই শুভেন্দু–বিতর্ক। তাই রাজ্যের রাজনীতিতে এই বৈঠক নিয়ে কৌতূহল তুঙ্গে উঠে যায়। ওই বৈঠকে শুভেন্দু ও অভিষেকের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা বিতর্কিত প্রশান্ত কিশোর (পিকে)। ছিলেন সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৌগত রায়ও। বৈঠক চলে সাড়ে নটা পর্যন্ত। সেখানেই নাকি পিকে এবং তৃণমূল নেতারা শুভেন্দুর মানভঞ্জনে সক্ষম হন। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠক নিয়ে সরাসরি কোনও ব্যাখ্যা দেননি। তবে জানিয়েছেন, বৈঠকে খোলাখুলি আলোচনা হয়েছে।
তবে সাংসদ সৌগত রায় দাবি করেছেন, ‘আলোচনা খুবই ভালো হয়েছে। শুভেন্দু বলেছে, সে দলেই আছে। সব সমস্যা মিটে গিয়েছে। কাল (বুধবার) নিজের অবস্থান স্পষ্ট করবে শুভেন্দু। আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, শুভেন্দু দল ছাড়বে না। বৈঠকে যে আলোচনা হয়েছে, সে বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে সব কথা জানিয়েছি।’ অবশ্য মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত এই বৈঠক নিয়ে শুভেন্দু মুখ খোলেননি। যতক্ষণ তিনি নিজে কিছু না বলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো ঠিক হবে না বলে অভিমত রাজনৈতিক মহলের। তবে শুভেন্দু–অভিষেক বৈঠক তৃণমূলকে যে কিছুটা স্বস্তি দেবে, সে কথাও বলেছেন রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা।
অরাজনৈতিক সভা করা নিয়ে তৃণমূল নেতাদের একাংশ নানা ভাবে আক্রমণ করে যাচ্ছিলেন শুভেন্দু অধিকারীকে। সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সমালোচনার ভাষা কখনও কখনও মাত্রাজ্ঞান ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। ছাড়িয়ে যাচ্ছিল শালীনতার সীমাও। যে কারণে বিভিন্ন সভায় ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন শুভেন্দু। কিন্তু কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে থামানো যায়নি। শুভেন্দুর মন্ত্রিত্ব ত্যাগের পর সেই আক্রমণ আরও বেড়ে যায়। সোমবারও নাম না করে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে তোপ দেগে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, সারদা–নারদা নিয়ে সিবিআই তদন্তের ভয়েই নাকি কয়েকজন নেতা বিজেপিতে যাওয়ার জন্য দল ছাড়ছেন।
শুধু কল্যাণই নন, শুভেন্দুর বিরুদ্ধে মুখ খোলেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। রবিবার ডায়মন্ড হারবারের এক সভায় নাম না করে শুভেন্দু অধিকারীকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, ‘তৃণমূলে রাতারাতি কেউ নেতা হননি। দলের কোনও নেতা বা কর্মী, কেউই প্যারাশুটে নামেননি, লিফটেও ওঠেননি।’ এমতাবস্থায় শুভেন্দুর সঙ্গে তৃণমূলের মীমাংসার পথ ক্রমশ কঠিন ও জটিল হয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে যে দুই পক্ষের সমঝোতা বৈঠক হতে পারে, এমন অনুমান করা বাস্তবিকই কঠিন ছিল। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলের লস্ট কেস। তিনি কবে দল ছাড়েন, বা বিধায়ক পদে ইস্তফা দেন, তা নিয়ে অনেকেই নিজেদের অনুমানের কথা বলছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে সমস্ত অনুমান বদলে যায়।
আবার অন্যদিকে, তৃণমূল নেতাদের একাংশ শুভেন্দুকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এ ক্ষেত্রে সবার আগে উল্লেখ করতে হয় সাংসদ সৌগত রায়ের কথাই। সোমবারও শুভেন্দুকে নিয়ে তিনি নিজের আশার কথা জানিয়েছেন। জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে ফের আলোচনা হতেই পারে। মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করলেও দল বা বিধায়ক পদে যে শুভেন্দু ইস্তফা দেননি, সে কথাও বারবার বলে এসেছেন। অবশেষে মঙ্গলবার রাতে সেই ঘটনাই ঘটল। এই বৈঠক নিয়ে শুভেন্দু এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া না জানালেও তাঁর অনুগামী নেতা ও কর্মীদের অধিকাংশই ভিন্ন পথে চলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কেউ কেউ ভিন্ন পথে চলা শুরুও করে দিয়েছিলেন।
যেমন মঙ্গলবার মেদিনীপুর জেলা পরিষদের মেন্টর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রণব বসু। এদিন জেলা পরিষদের বড়বাবুর কাছে তিনি ইস্তফা দিয়েছেন। রাজ্যের কিছু জায়গায় এমনই নানা ঘটনা একটা–দুটো করে ঘটতে শুরু করেছে। তার মধ্যে শুভেন্দু অধিকারী যদি দলে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং মন্ত্রিত্বে ফিরে যান, তা হলে তাঁর অনুগামীরা কী করবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে রাজনৈতিক মহলের। শুভেন্দু অধিকারী কি তাঁদেরও নিজেদের পদে ফিরে যাওয়ার কথা বলবেন? প্রশ্ন অনেক রাজনীতি বিশ্লেষকের।