বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা: এ যেন তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ নেতা শুভেন্দু অধিকারী বিতর্কের পুনরাবৃত্তি। তবে শুভেন্দুর জায়গায় চলে এসেছেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার কলকাতার হরিদেবপুরে ফোঁস করে উঠেছিলেন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। আর রবিবার সকালে উত্তর কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেল পশ্চিমবাংলার বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে বেশ কিছু পোস্টার এবং ফ্লেক্স। এ ছাড়া, শুভেন্দুর বিরুদ্ধে যেমন অশালীন ও তীব্র আক্রমণ শানিয়েছিলেন দলেরই নেতা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, এবারও ঠিক একই ভাবে রাজীবের বিরুদ্ধে তোপ দাগলেন অরূপ রায়। আবার সৌগত রায় যেমন শুভেন্দু–বিতর্কের মীমাংসা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, শুভেন্দু সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করছিলেন, ঠিক সেইভাবে ফিরহাদ হাকিম কিন্তু রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে ভালো কথাই বলে চলেছেন।
এদিন শ্যামবাজার, কাঁকুড়গাছি, শোভাবাজার, উল্টোডাঙা ছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে পোস্টার দেখা যায়। পোস্টারগুলির কোনওটিতে লেখা হয়েছে, ‘কাজের মানুষ কাছের মানুষ’, কোনওটিতে ‘ছাত্র যুবর নয়নের মণি’, আবার কোনও কোনও পোস্টারে লেখা রয়েছে, ‘সততার প্রতীক’। সকাল থেকে পোস্টারগুলি মানুষের নজরে আসতে শুরু করলে চাঞ্চল্য তৈরি হয়। এ ছাড়া পোস্টারগুলি লাগানো হয়েছে রাস্তার বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলিতে, যে জায়গাগুলি থেকে সেগুলি সহজেই সকলের চোখে পড়বে। শ্যামবাজার মোড়ে অন্তত দশটি জায়গায় এমন পোস্টার দেখা গিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, এই জায়গাগুলিতে কিছুদিন আগে ‘আমরা দাদার অনুগামী’ বলে শুভেন্দু অধিকারীর সমর্থনেও পোস্টার লাগানো হয়েছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, রাজীব কি তা হলে শুভেন্দুর পথই অনুসরণ করছেন? এ বিষয়ে দু’জনের মধ্যে কি গোপনে কোনও সমঝোতা রয়েছে?
যদিও বিষয়টি নিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে কিছু জানা যায়নি। তবে শুভেন্দুর পোস্টারে যেমন ‘দাদার অনুগামী’ লেখা থাকত, রাজীবের সমর্থনে লাগানো পোস্টারগুলিতে লেখা রয়েছে ‘উত্তর কলকাতা স্পোর্টস লাভার্স অ্যাসোসিয়েশন’। কোনও কোনও পোস্টারে ‘উত্তর কলকাতা উন্নয়ন পরিষদ’ লেখাও দেখা গিয়েছে। উল্লেখ্য, শনিবারই দলের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন রাজীব। হরিদেবপুর এলাকার একটি বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার খুব খারাপ লাগে, যখন দেখি যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেও আমাকে পিছনের সারিতে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। যে মুখগুলোকে মানুষ পছন্দ করে না, যাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত, শুধু স্তাবক বলে তাঁদেরই আজ সামনের সারিতে আনা হচ্ছে। তারাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। আসলে স্তাবকতা করাই যেন এখন যোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন হচ্ছে স্তাবকতার যুগ। আমি সেটা করতে পারি না।’
এর পর রবিবার রাজীবের নামে পোস্টার পড়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক মহলে বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। শুভেন্দু অধিকারীর মতো তিনিও মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন কিনা, আপাতত সেদিকেই তাকিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। এর পর রবিবারই বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন আরেক মন্ত্রী অরূপ রায়। রাজীবের বিরুদ্ধে তিনি তোপ দেগে বলেন, ‘চালুনি আবার ছুঁচের বিচার করে। যিনি বড় বড় কথা বলছেন, তিনি নিজের বিচারটা আগে করুন। চোরের মায়ের বড় গলা! দলে থেকে দলের বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেলিং করছেন। এটা করা যে অন্যায়, তা কি তিনি বুঝতে পারছেন না? পারবেন কী করে? কিন্তু তৃণমূলে এ–সব চলবে না। এ–সব বরদাস্ত করা হবে না।’ উল্লেখ্য, রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ রায় তৃণমূলের মধ্যেই ‘রাজীব–বিরোধী’ হিসেবে পরিচিত। এর আগেও রাজীব ইঙ্গিতবহ আক্রমণ শানিয়েছিলেন, যে কারণে দলের সাংগঠনিক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল অরূপ রায়কে। যাই হোক, ঠিক এই রকমই পূর্ব মেদিনীপুরে শুভেন্দু বিরোধী হিসেবে পরিচিত রামনগরের বিধায়ক অখিল গিরি।
এদিন রাজীব সম্পর্কে অরূপ ছিলেন আগাগোড়া আক্রমণাত্মক। তিনি বলেন, ‘দলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আছেন। কেউ যদি সবার চাইতে নিজেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন, তা হলে ভাবনাটা তাঁরই। যাঁরা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ, তাঁরা কাজ করছেন নিঃস্বার্থভাবে। তাঁরা মন্ত্রীও নন, বিধায়কও নন। কিন্তু যিনি এত বড় বড় কথা বলছেন, তিনি দলের জন্য নিজে কী করেছেন? দলের জন্য কিছু ত্যাগ না করে শুধু নিতেই তো এসেছেন। যিনি বড় বড় কথা বলছেন, তাঁদের মুখে এ–সব কথা শোভা পায় না। তৃণমূল হল জনসমুদ্র। মনে রাখবেন, একটু–আধটু জল ছিটকে গেলেও সমুদ্রের জল কোনওদিন কমে না।’ যদিও রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে তিনি কিছু বলেননি। অন্যদিকে, রাজীব প্রসঙ্গে ফিরহাদ হাকিম কিন্তু যথেষ্ট নমনীয়। শনিবার যেন তাঁর সম্পর্কে তিনি ইতিবাচক কথা বলেছিলেন, এদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এদিনও তিনি বলেন, ‘রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় দলেই আছেন, দলেই থাকবেন। আর, রাজীব যথেষ্ট পরিণত নেতা। কেউ ফাঁপিয়ে দিতে চাইলে, সফল হবেন না বলেই মনে হয়।’
এদিকে, এই বিতর্ক মাথাচাড়া দেওয়ায় মুখ খুলেছে বিজেপিও। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বিতর্ককে উসকে দিতে বলেছেন, ‘রাজীব যদি আমাদের দলে আসেন, তা হলে তাঁকে স্বাগত জানাব। খুব ভালো ছেলে রাজীব। কাজও ভালো করেন। তৃণমূলে যে রাজীব ভালো নেই, তা তো তাঁর বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার।’ এর পরই তৃণমূলকে খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘একবার শুভেন্দু মুখ খুলছেন, অন্য সময় খুলছেন রাজীব। আবার কোনও কোনও সময় মুখ খুলছেন অন্যরা। দলে কেউই ভালো নেই। তাই একে একে সবাই সরব হচ্ছেন।’ তৃণমূলের পতন শুধু সময়ের অপেক্ষা বলেই তিনি মনে করেন। অন্যদিকে, তৃণমূলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিলেন দলেরই বিধায়ক উদয়ন গুহ। এমনকী, জানিয়ে দিলেন, দলের লোকেরাই দলের ক্ষতি করছে। বিজেপির প্রস্তাবও তাঁর কাছে রয়েছে বলে প্রকাশ্যেই দাবি করেছেন তিনি। যথারীতি এই বিষয়টি নিয়েও গবেষণা শুরু হয়েছে বাংলার রাজনীতিতে।