বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা: দু’দিনের পশ্চিমবাংলা সফরের শেষদিনে বোলপুর থেকে রাজ্য সরকারকেই নিশানা করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বললেন, ‘দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র, হিংসায় ভারতে সবার উপরে বাংলা।’ এখানেই থেমে যাননি তিনি, একই সঙ্গে দাবি করলেন, ‘শিল্প, স্বাস্থ্য, কৃষি, মাথাপিছু আয়, শিক্ষা— সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে এই রাজ্য।’ যদিও পাল্টা আক্রমণে গিয়েছে তৃণমূলও। সাংসদ সৌগত রায় দাবি করেছেন, ‘ঠিক বলছেন না অমিত শাহ। গত ৬০ বছরে পশ্চিমবাংলা তো বটেই, সারা ভারতে আর কোনও রাজ্যে পশ্চিমবাংলার মতো উন্নয়ন হয়নি।’ জবাবে বিজেপির রাজ্য নেতা সায়ন্তন বসু বলেছেন, ‘সৌগত রায় নিজেও জানেন, তিনি যা বলছেন, তা ঠিক বলছেন না। বলতে হয় বলেই বলছেন তিনি।’
এদিন বিকেলে শান্তিনিকেতনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে অমিত শাহ রাজ্য সরকারের সমালোচনায় কোনও রকম রাখঢাক করেননি। পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, ‘রাজ্যের মানুষই তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে। রাজ্যের মানুষই বিজেপিকে ক্ষমতায় বসাবে। আর এই রাজ্যের ভূমিপুত্রই হবেন মুখ্যমন্ত্রী।’ কিন্তু তিনি কে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, নাকি শুভেন্দু অধিকারী, সে বিষয়ে মুখ খোলেননি তিনি। এর পর রীতিমতো তথ্য দিয়ে তিনি রাজ্য সরকারের দশ বছরের ব্যর্থতা তুলে ধরেন। ১৯৬০ সালের সঙ্গে রাজ্যে শিল্প, কৃষি, মাথা পিছু আয় এবং স্বাস্থ্যের হাল নিয়ে তুলনা করে তিনি বিঁধতে শুরু করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে। এই সময়ই তিনি বলেন, ‘এই রাজ্য গোটা দেশে প্রথম স্থান অধিকার করেছে দুর্নীতিতে, তোলাবাজিতে, আর পরিবারতন্ত্রে।’ বিজেপি দল ও নেতাদের ‘বহিরাগত’ বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগের জবাবে এদিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মনে হয় তাঁর মাথাটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে। তিনি জাতীয় দলের অর্থটাই ভুলে গিয়েছেন। তিনি জানেন না, বাংলার মানুষ উদার এবং খোলা মনের। তাঁরা তাঁর ওই প্রচারে কান দেবেন না।’
সম্প্রতি বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি (জগৎপ্রকাশ) নাড্ডার কনভয়ে হামলা প্রসঙ্গে এদিন শাহ বলেন, ‘আমার ধারণা, এটা নাড্ডাজির কনভয়ে হামলা নয়, এটা গণতন্ত্রের ওপরই হামলা। ক্ষমতার দম্ভেই এই হামলা চালানো হয়েছে। গণতান্ত্রিক পথেই মানুষ এই হামলার জবাব দেবেন।’ নাড্ডার কনভয়ে হামলার পরই রাজ্যের তিন আইপিএস অফিসারকে ডেপুটেশন পোস্টিং দিয়ে বদলি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন অভিযোগ করেছিলেন, এই ঘটনা নাকি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত। এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ঠিক বলছেন না মমতা দিদি। এমন কোনও কাজ আমরা করিনি, যা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত করে। কেউ যদি এমন অভিযোগ করেন, তা হলে তাঁকে প্রমাণ দিতে বলুন।’ উল্লেখ্য, আইপিএস আইন অনুযায়ী, রাজ্য সরকার যদি ‘এনওসি’ নাও দেয় এবং বিরোধ যদি চরম পর্যায়ে পৌঁছয়, তা হলে কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছে করলে আইপিএস অফিসারদের রাজ্য থেকে তুলে নিতে পারে। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি ঠিক নয় বলে দাবি কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক মহলের।
এদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুখ খোলেন রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সম্ভাবনা প্রসঙ্গেও। তিনি বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী হয়তো সবার সমবেদনা পাওয়ার জন্য এ–সব কথা বলছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসন জারির বিষয়টি এতটাই ভারী যে, এই রকম সাংবাদিক সম্মেলনে তা নিয়ে বলা সম্ভব নয়। উচিতও নয়।’ শনিবারের মতো রবিবারও রাজ্যে ব্যস্ততার মধ্যে কাটে অমিত শাহের। সকালে কলকাতার দমদম বিমান বন্দর থেকে হেলিকপ্টারে বোলপুরে আসেন। যান বিশ্বভারতীতে। প্রথমেই উপাসনা গৃহ ঘুরে দেখেন। বলেন, ‘আজ আমার সৌভাগ্যের দিন। বিশ্বভারতীতে আসার সুযোগ হল আমার। এখানে সেই মহামানবকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিলাম, যিনি গোটা বিশ্বে ভারতীয় কলা ও সংস্কৃতিকে উচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন।’ এর পর তিনি যান সঙ্গীত ভবনে। দর্শকাসনে বসে সেখানকার পড়ুয়াদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখেন। গান শোনেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে ছিলেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়, মুকুল রায়, দিলীপ ঘোষ এবং রাহুল সিনহা।
এর পর কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য বিজেপি নেতাদের নিয়ে তিনি শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখেন। ভিজিটর্স বুকে নিজের প্রতিক্রিয়াও লেখেন। তার পর বাংলাদেশ ভবনে যান। শ্যামবাটিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে গান শোনান বাউল কন্যা ১১ বছরের বর্ষা দাস। সেখানে অমিত শাহকে গান শোনান বাউল বাসুদেব দাসও। দুপুরে এক বাউল বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজ সারেন। বিকেলে তৃণমূলের প্রতাপশালী নেতা অনুব্রত মণ্ডলের গড় বোলপুরে ডাকবাংলো মোড় থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত মেগা র্যালি করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর নেতৃত্বে বিজেপির সেই রোড শোয়ে যে জনপ্লাবন এদিন দেখা গেল, তা রাজ্যের শাসক দলকে চিন্তায় রাখবে বলে ধারণা তথ্যাভিজ্ঞ মহলের। সেই রোড শোয়ে অমিত শাহ বলেন, ‘বাংলার ক্ষমতায় বিজেপিই আসবে। তার পর পাঁচ বছরে এই বাংলাকে সোনার বাংলা গড়ে দেখিয়ে দেবে বিজেপি।’