বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা : তৃণমূল কি এতটাই খারাপ? এই প্রশ্নই উঠতে শুরু করেছে সদ্য তৃণমূল ছেড়ে আসা শুভেন্দু অধিকারীর কথায়। শনিবার কলকাতার হেস্টিংসে বিজেপিতে নবাগতদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘২১ বছর তৃণমূলে কাটিয়েছি। আজ এ কথা ভেবে আমার লজ্জা হচ্ছে।’
কিন্তু কেন এমন মন্তব্য করলেন শুভেন্দু? তার উত্তর দিয়েছেন তিনি নিজেই। বলেছেন, ‘তৃণমূল একটি কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। সেইজন্য এই দলে আর শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। দলের এমন ধাঁচ যে পোক্ত হচ্ছে, আমরা তা বুঝতে পারতাম না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু বিশ্বাস করতাম, সবই হয়তো আমাদের মনের ভুল। সবই ঠিক আছে। পরে বুঝতে পেরেছি, মনের আশঙ্কাটাই সত্য। অথচ আমি এবং আমার মতো যাঁরা তৃণমূল ছেড়ে এখন বিজেপিতে এসেছেন, রাজনীতিতে তাঁরা প্রকৃত পথ খুঁজে পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা আজ একটি প্রকৃত রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ পেয়েছেন।’ সংবাদ মাধ্যমের সৌজন্যে তাঁর এমন মন্তব্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমবাংলার সর্বত্র। ফলে মুখ খোলেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘শুভেন্দুর কথার কোনও জবাব আমি দেব না। যা বলার, তা বলবেন, দলের কোনও ব্লক সভাপতি।’ যদিও রাজনৈতিক মহলের ধারণা, নিজের এমন মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি আসলে নিজেকে শুভেন্দুর তুলনায় বিশাল মাপের নেতা বলে সংবাদ মাধ্যমের কাছে জাহির করলেন।
বিজেপিতে যোগদানের আগে এবং রাজ্যের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নাম না করে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করে তৃণমূলকে অনেকবার অস্বস্তিতে ফেলে আসছিলেন শুভেন্দু। কিন্তু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর আর ইঙ্গিত নয়, সরাসরিই এখন নানা ইস্যুতে তৃণমূলের সমালোচনা করছেন শুভেন্দু। রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, শুভেন্দু যে ভাবে তৃণমূলের সমালোচনা করছেন, তা যে তৃণমূল নেতা ও কর্মীদের ভালো লাগছে না, সে কথা বলাই বাহুল্য। সূত্রের খবর, সেই কারণে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে নানা রকম কৌশল তৈরি করছে তৃণমূল। কৌশল রচনার নেপথ্যে রয়েছেন স্বয়ং দলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর। উল্লেখ্য, শনিবারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ঘিরে হেস্টিংসে বিজেপি কার্যালয়ের সামনে গোলমাল বাধে। গোটা চত্বরই রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। জানা গিয়েছে, কার্যালয়ের সামনে প্রথমে কিছু ব্যক্তি শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করেন। তখন বিজেপি কর্মী–সমর্থকরা বাধা দিতে গেলে গোলমাল শুরু হয়ে যায়। বিজেপির অভিযোগ, তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরাই বিজেপির ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বানচাল করতে এই ঝামেলা পাকিয়েছে।
যদিও সমস্ত অভিযোগই অস্বীকার করেছে তৃণমূল। তাদের বক্তব্য, শুভেন্দু অধিকারীকে তারা তেমন বড় নেতা বলে মনে করে না যে, বিজেপির কার্যালয়ের সামনে গিয়ে তারা গোলমাল পাকাবে। তৃণমূল আরও জানিয়েছে, ওই গোলমাল আসলে বিজেপির গোষ্ঠী কোন্দলের ফল। শুধু শুভেন্দুই নন, এদিন সাংসদ সুনীল মণ্ডল সম্পর্কেও মুখ খোলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বলেন, ‘আমি কেন সুনীল মণ্ডল সম্পর্কে কথা বলব? তিনি আবার নেতা হলেন কবে? হাত গোনা লোকের মধ্যেও তিনি আসেন না!’ পাল্টা মুখ খুলেছেন সুনীল মণ্ডলও। তিনি বলেছেন, ‘এত অহঙ্কার ভালো নয়। মে মাসে নির্বাচনের পর এই অহঙ্কার তাঁর আদৌ থাকবে তো?’ উল্লেখ্য, সুনীল মণ্ডলের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সেই প্রসঙ্গেই ওই কথা বলেছিলেন পার্থবাবু।
এদিন শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে তোপ দাগেন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষও। তিনি বলেন, ‘একই পরিবারের এতজন এতগুলি পদের অধিকারী ছিলেন। তখন লজ্জা করেনি, তাই না? এখন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর এ–সব কথা মনে হচ্ছে? এ–সব বলে কোনও লাভ হবে না।’ এদিন আচমকাই মুখ খুলেছেন একদা তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা মদন মিত্র। বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেছেন, ‘একুশের ভোট বাংলার ডার্বিতে জয় হবে মমতারই। বিজেপি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই জয় দেখবে। পতাকা লাগানোর লোকও খুঁজে পাবে না বিজেপি।’ এর পরই তিনি নিশানা করেন সদ্য দলত্যাগী শুভেন্দুকে। বলেন, ‘বিজেপি যাঁকে বাংলার বাঘ বলে প্রজেক্ট করতে চাইছে, সেই শুভেন্দু যে আসলে কাগুজে বাঘ, তা আমি ভোটেই প্রমাণ করে দেব।’
এর পর শুভেন্দুকে আক্রমণ করে সরাসরি বলেন, ‘শুভেন্দু চলে যাওয়ায় যাঁরা মনে করছেন, তৃণমূলের বড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, তাঁরা জেনে রাখুন, আমি রাজ্যের বুথে বুথে শুভেন্দু অধিকারী তৈরি করে দেব।’ উল্লেখ্য, রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছে, শুভেন্দু তৃণমূল ছাড়তেই যে কয়েকজন নেতা অতিসক্রিয় হয়ে উঠতে চাইছেন, তাঁদের মধ্যে একজন মদন মিত্রও। সারদা মামলায় জেলে গিয়ে তিনি কোণঠাসা হয়ে পড়েন রাজ্য রাজনীতিতে। এক প্রকার রাজনৈতিক নির্বাসনেই কাটিয়েছেন এতদিন। কিন্তু শুভেন্দু দল ছাড়ার পর তাঁকে নানা রকম রাজনৈতিক মন্তব্য করতে দেখা যাচ্ছে। এদিকে, তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোরের একটি মন্তব্য দল এবং দলনেত্রীর চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, ওই বৈঠকে প্রশান্ত কিশোর জানিয়েছেন, আরও কয়েকজন হেভিওয়েট নেতা নাকি সদলবলে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন।