বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : যতদিন যাচ্ছে, মিটেও যেন মিটছে না তৃণমূল–রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় সমস্যা। বরং ৩১ জানুয়ারি যত এগিয়ে আসছে, ততই যেন স্নায়ুর চাপ বেড়ে চলেছে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের। তৃণমূলের অভ্যন্তরে জল্পনা, ৩১ জানুয়ারি হাওড়ায় সভা করবেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ওইদিনই নাকি তাঁর হাত থেকে গেরুয়া পতাকা হাতে তুলে নিতে পারেন রাজীব। স্বাভাবিক কারণেই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে এ ব্যাপারে কোনও রকম সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
মঙ্গলবার দিনটা তৃণমূলের পক্ষে মোটেই ইতিবাচক ছিল না। এদিনই লক্ষ্মীরতন শুক্লা মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন। এমনকী, দলের সমস্ত পদও ছেড়ে দিলেন। সেই ধাক্কার মধ্যেই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এড়িয়ে গেলেন তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বৈঠক। এদিন তাঁর মানভঞ্জনে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই বৈঠকে যাননি রাজীব। ইঙ্গিতবহ ভাবে কয়েকদিন ধরেই বলে যাচ্ছিলেন, পরিষ্কার ভাবমূর্তি রেখেও যদি সম্মান পাওয়া না যায়, তা হলে সেই দলে থেকে লাভ নেই।
এদিন ঘনিষ্ঠ মহলে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি জানিয়েছেন, তাঁর শরীর ভালো নেই। তাই বৈঠকে যাননি। কিন্তু কথা হল, এর আগে শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক ছিল। সেই বৈঠকেও মন্ত্রী রাজীব যোগ দেননি। শুধু তিনিই নন, ওই বৈঠকে ছিলেন না গৌতম দেব, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, অরূপ রায়, সুজিত বসু প্রমুখ। উল্লেখ্য, এই চারজনকে নিয়েও তৃণমূলের অভ্যন্তরে নানা কথা শোনা যাচ্ছে।
যাই হোক, তার আগের ক্যাবিনেট বৈঠকেও রাজীব অনুপস্থিত ছিলেন। বিষয়টিকে তাই নেহাতই জল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া শেষ কয়েকদিন ধরে দলের কোনও কর্মসূচিতেই তিনি যোগ দেননি। ৩১ জানুয়ারি দিনটি ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তাই কি দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছেন রাজীব? প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তৃণমূলের অভ্যন্তরেই।
এদিকে, মঙ্গলবার ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এবং তৃণমূলের জেলা সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠান লক্ষ্মীরতন শুক্লা। ইস্তফাপত্রে লক্ষ্মী জানিয়েছেন, আপাতত রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে খেলায় ফিরতে চান তিনি। যদিও হাওড়ায় দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই তিনি ইস্তফা দিয়েছেন বলে দলের একাংশের মত। পরে জানা যায়, তৃণমূল কংগ্রেসের সমস্ত পদই ছেড়ে দিয়েছেন লক্ষ্মীরতন।
বিষয়টি নিয়ে নানা কথা রটতে শুরু করে। যে কারণে মুখ খুলতে হয় স্বয়ং দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এদিন নবান্নে মমতা বলেন, ‘লক্ষ্মী ভালো ছেলে। খেলাধুলোর জগত থেকে এসেছে। রাজনীতি থেকে অব্যাহতি চেয়েছে। আমি রাজ্যপালকে ওর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার প্রস্তাব দেব। ও বিধায়ক থাকবে। আর তো কয়েকমাস পরেই ইলেকশন। এতে কোনও ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার নেই। ওর প্রতি আমার শুভেচ্ছা রইল।’
যেহেতু পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজীবের বৈঠক এড়িয়ে যাওয়ার দিনেই ঘটনাটি ঘটেছে, তাই দুটি ঘটনার মধ্যে কোনও যোগসূত্র আছে কিনা, তা নিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে চর্চা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু লক্ষ্মীরতনের ইস্তফা প্রসঙ্গে বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘তিনি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন, আমি জানি না। অনেক দিন ধরে ওঁর সঙ্গে আমার কোনও আলাপ–আলোচনাও হয়নি। কেন হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নিলেন তা একমাত্র লক্ষ্মীই বলতে পারবেন।’
এর পরই বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের অনেক নেতাই মুখ খুলতে শুরু করেন। তাঁকে রীতিমতো আক্রমণ করেন মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। তিনি বলেন, ‘ভোটের দু–তিনমাস আগে দলের দেওয়া দায়িত্ব ত্যাগ করেছেন তিনি। বাকিটা মানুষ দেখবেন। ক্রীড়া জগতের তারকা লক্ষ্মীরতন শুক্লাকে যথেষ্ট সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল। তাঁকে বিধায়ক করা হয়েছে, মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছে। আর কত দেবে? কী চায় এঁরা?’
কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় বলেছেন, ‘লক্ষ্মীর কোনও ক্ষোভ আছে বলে আমি জানতাম না। লক্ষ্মী ভালো খেলোয়ার। ভালো ছেলে। ভালো মন্ত্রী ছিল। ওকে সবাই পছন্দ করত। ওদের জেলা রাজনীতির ব্যাপারে আমি জানি না। তবে আমার এখনও মনে হয়, ওকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা দরকার। যদিও মন্ত্রিসভার ব্যাপারটা মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করবেন। আমি আবেদন করব, লক্ষ্মী পদত্যাগপত্র তুলে নিক। লক্ষ্মী যদি দল ছেড়ে দেয়, তবে দলের প্রতি তা ধাক্কা তো বটেই।’
রাজ্যের সমবায়মন্ত্রী অরূপ রায় বলেছেন, ‘এটা লক্ষ্মীর ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখন দল সিদ্ধান্ত নেবে। আমার সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল, এই ধরনের কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। লক্ষ্মী আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক।’ যদিও ঘনিষ্ঠ মহলে নিজের ক্ষোভ চেপে রাখেননি লক্ষ্মীরতন। তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, ‘সাড়ে ৪ বছরের মন্ত্রিত্বে একটিও ফাইল আসেনি তাঁর কাছে। মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও দেওয়া হয়নি কোনও প্রশাসনিক ক্ষমতা। কোনও কাজ করতে গেলেও তাতেও বাধা দেওয়া হয়েছে।’
মুখ খুলেছেন তৃণমূল বিধায়ক বৈশালী ডালমিয়াও। তিনি কার্যত দলের একাংশের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন এদিন। লক্ষ্মীরতনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তৃণমূলেরই কিছু লোক দলের যাঁরা ভালো চান, তাঁদের বিরোধিতা করছেন। দুর্ব্যবহার করছেন। দল ছাড়লেই অনেকে বেইমানও বলতে শুরু করছেন। কিন্তু যাঁরা ভিতরে ভিতরে উইপোকার মতো দলকে নষ্ট করেছেন, তাঁরা কি বেইমান নন? দলের একটা অংশ আছে, যারা শুধু লক্ষ্মীকে নয়, আমাদের অনেককেই কাজ করতে দিচ্ছে না। পুরনো কর্মীকে কাজ করতে দিচ্ছে না। তারা তো আরও বেশি বেইমান। আমার মনে হয়, এই বেইমানগুলোকেই আগে দল থেকে বের করে দেওয়া উচিত।’
পুরো বিষয়টি নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়েননি বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তিনি এদিন বলেছেন, ‘রোজই দিদির দলের উইকেট পড়ছে। দিদিমণির দলের ভাঙন শুরু হয়ে গিয়েছে। এই ভাঙন দিদি আর থামাতে পারবেন না।’