বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: স্বাধীন ভারতের প্রথম সরকার তৈরি হয়েছিল নেতাজির নেতৃত্বেই। দেশের ১৩০ কোটি মানুষ সেইজন্য আজও তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এক অনুষ্ঠানে এই মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। স্বাধীনতার ৭৪ বছরে নেতাজির অবদানকে এই প্রথম ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিলেন। যদিও নেতাজির প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি যে বদলাচ্ছে, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল মোদির প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই। তিনিই ঘোষণা করেছিলেন, জওহরলাল নেহরু নন, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। কেন না, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে প্রথম আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করেছিলেন নেতাজিই। শুধু তাই নয়, সেই সরকার একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সমস্ত রকম পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছিল।
নেতাজির জন্মদিনকে এ বছরই ভারত সরকার ‘পরাক্রম দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি তাঁর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী সারা বছর ধরে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শনিবারই সেই কর্মসূচির সূচনা হয়। এদিন মূল অনুষ্ঠানটি হয় কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। সেখানে নিজের বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘সেই ছেলেবেলায় যেদিন প্রথম নেতাজির নাম শুনি, তার পর থেকে যে কোনও পরিস্থিতিতে থাকি না, তাঁর নাম কানে এলেই আলাদা অনুপ্রেরণা কাজ করে। এমনই মহান ব্যক্তি তিনি ছিলেন যে, তাঁর মহত্ত্ব ব্যাখার জন্য শব্দও কম পড়ে যায়। তিনি চেয়েছিলেন শক্তিশালী এবং আত্মনির্ভর ভারত। আজ শক্তিশালী ভারতকে দেখে তিনি নিশ্চয়ই গর্বিত হতেন। কারণ, আত্মনির্ভর ভারতেরই লক্ষ্য ছিল নেতাজির।’ এদিন তিনি আরও বলেন, ‘আজ শুধু নেতাজির জন্ম হয়নি, ভারতের নয়া আত্মগৌরবেরও জন্ম হয়েছিল। আমি দেশমাতার সেই বীর সন্তান নেতাজির মাকে শ্রদ্ধা জানাই, যিনি এমন রত্ন উপহার দিয়েছিলেন ভারতকে।’
এর পরই তিনি চলে আসেন বাংলার প্রসঙ্গে। বলেন, ‘বাংলার জন্য ভারত বারবার গর্বিত হয়েছে। বাংলার পুণ্যভূমি উপহার দিয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অনুকূল ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, রামমোহন রায়, মা সারদাময়ী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাথ সাহা, প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রনাথ রায়দের।’ ‘পরাক্রম দিবস’ নিয়ে এদিন দুপুরে অন্য একটি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘এটা কোন ভাষা? আমি জানি না।’ সেই কারণেই কিনা, তা প্রধানমন্ত্রী মোদি পরিষ্কার জানাননি। তবে এদিন সন্ধেয় ভিক্টোরিয়ার অনুষ্ঠানে তিনি ‘পরাক্রম’ শব্দের ব্যাখ্যা দেন। জানান, অভিধান অনুযায়ী শৌর্য, বীর্য, শত্রুকে পরাজিত করা শব্দগুলির সমার্থকই হল ‘পরাক্রম’। অর্থাৎ এই শব্দ দিয়ে বীরত্বকেই বোঝানো হয়। পরাক্রমের সবকটি বিশেষণই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্য সুপ্রযুক্ত। তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘এ–সব আমাদেরও পরাক্রম অর্থাৎ আমাদের দাপট এবং একই সঙ্গে আমাদের প্রেরণাও।’
শনিবারের এই অনুষ্ঠানে বিকেল ৫টা নাগাদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ সিং প্যাটেলের পরের বক্তা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময়ই একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। মমতা যখন বক্তব্য পেশ করতে ডায়াসে যান, তখন হঠাৎই সভায় উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে থেকে উঠে আসে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান। আর তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করেননি মমতা। প্রথমে পরিস্থিতি সামাল দিতে সঞ্চালক জনতাকে শান্ত থাকতে বলেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা শান্ত হন। এই পুণ্যলগ্নে মুখ্যমন্ত্রীকে কিছু কথা বলার সুযোগ দিন।’ এর পর মাইক হাতে নেন মুখ্যমন্ত্রী। হিন্দিতে বলেন, ‘আমার মনে হয়, সরকারি অনুষ্ঠানের একটা আলাদাই মর্যাদা, সম্ভ্রম থাকে। এটা সরকারি অনুষ্ঠান। কোনও রাজনৈতিক দলের সভা নয়। এটা সকল রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের অনুষ্ঠান। কলকাতায় এই অনুষ্ঠান করায় আমি প্রধানমন্ত্রী, সংস্কৃতি মন্ত্রকের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু কাউকে আমন্ত্রণ করে তাঁকে অসম্মান করা শোভা দেয় না। তাই আমি এর প্রতিবাদে এই অনুষ্ঠানে আর কিছু বলব না।’
এই ঘটনার পর পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রেক্ষিতের মানুষও ঘটনার সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। যাঁরা স্লোগান দিয়েছেন, তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েও অনেকে সরব হন। পাশাপাশি অনেকে এই মন্তব্যও করেন, যেহেতু এই অনুষ্ঠান নেতাজির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে, তাই মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি এড়িয়ে যেতেই পারতেন। আবার কেউ কেউ এমনও বলেছেন, ওই স্লোগানের জন্য এই অনুষ্ঠানে যেমন রাজনৈতিক ছায়া পড়েছে, ঠিক সে ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী নিজেই রাজ্য সরকারের অনুষ্ঠানগুলিকে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেই পরিণত করে থাকেন। তাই বিষয়টি আসলে একই। তবে এদিনের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েন। সেই বিরক্তি তাঁর চোখে–মুখেও ফুটে ওঠে। বিজেপির রাজ্য নেতা শমীক ভট্টাচার্যও ঘটনাটি ‘অনভিপ্রেত ও দুর্ভাগ্যজনক’ বলে অভিহিত করেছেন।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার দুপুরে কলকাতায় আসেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে সরাসরি এলগিন রোডে নেতাজি ভবনে চলে যান তিনি। সেখান থেকে যান ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। সেখানে একটি ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে যোগ দেন। নেতাজির মূর্তিতে শ্রদ্ধাও জানান। তার পর ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে তিনি চলে আসেন ভিক্টোরিয়াল মেমোরিয়ালে। সেখানে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ও উপস্থিত ছিলেন। পরে সেখানে যান পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। নেতাজিকে নিয়ে সেখানে বিশেষ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রকাশ করেন বিশেষ ডাক টিকিট। নেতাজিকে সম্মান জানিয়ে হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।
এ ছাড়া এদিন পশ্চিমবাংলা সরকারের তরফেও নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়। দুপুরে শ্যামবাজারে নেতাজি মূর্তির পাদদেশ থেকে সরকার ও শাসক দলের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পদযাত্রা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আসেন রেড ডোরে। সেখানে নেতাজি মূর্তিতে মালা দেন। সেখানে কলকাতাকে ফের ভারতের রাজধানী করার দাবি জানান পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেন, ‘এক সময় ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। কলকাতা থেকে ইংরেজরা ভারতবর্ষ চালাত। আজ ভারতবর্ষের একটা রাজধানী কলকাতা কেন হবে না? কলকাতাকে ফের ভারতের অন্যতম রাজধানী করতে হবে।’ পরে অবশ্য সারা দেশের চার প্রান্তে রাজধানী করার দাবি তোলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘আমরা সংকীর্ণ মানসিকতার নই। আমরা সবার জন্য বলছি।’
তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ, উত্তর, পূর্ব ও উত্তর পূর্ব— দেশের এই চার প্রান্তে ভারতের রাজধানী থাকতে হবে। সংসদের চারটে অধিবেশন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভারতবর্ষের ৪টে জায়গায় করা উচিত। দক্ষিণে তামিলনাড়ু, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ বা কেরল; উত্তরে উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশ; পূর্বে বিহার, ওডিশা, বাংলা অর্থাৎ কলকাতা এবং আর একটা উত্তর–পূর্বাঞ্চলে রাজধানী করা যেতে পারে।’ এ ছাড়া রেড রোডে ফরওয়ার্ড ব্লক এবং অন্য বামপন্থী দলগুলির তরফেও নেতাজি মূর্তিতে মালা দেওয়া হয়। প্রদেশ কংগ্রেস দফতরেও নেতাজির প্রতিকৃতিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।