করোনার ভয়াল থাবায় থমকে গেছে গোটা বিশ্ব। সেই সঙ্গে বিশ্বের অর্থনীতিতে নেমে এসেছে বড় বিপর্যয়। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন।
তবে করোনার আঘাতে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। প্রায় এক বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশি শিক্ষার্থীরা রয়েছেন মহাসঙ্কটে।
ইউরোপ কিংবা আমেরিকা অথবা অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে যে সকল শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান তাদের অনেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরিতে মনোনিবেশ করেন। যার মাধ্যমে তাদের অনেকে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় খরচের সংস্থান করেন।
তবে করোনা পরিস্থিতিতে তাদের অনেকে দীর্ঘ সময় ধরে সাময়িকভাবে এ সকল খণ্ডকালীন চাকরি থেকে বিচ্ছিন্ন। বিভিন্ন দেশে সরকারের পক্ষ থেকে কর্মজীবীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করা হলেও শিক্ষার্থীরা থেকে গেছেন তার বাইরে। অনেকে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নিজেদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়েছে তবে বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কোনও উদ্যোগ এ সকল দেশের সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়নি।
তবে বরাবরের মতো করোনার তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী বিদেশের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। যদিও যে সকল শিক্ষার্থী স্কলারশিপের আওয়তায় বাইরের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন, করোনার এ সময়ে তাদেরকে খুব একটা প্রতিবিন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি।
যারা সেলফ ফাইন্যান্সিং স্টুডেন্ট বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস যেনও তাদের গলায় রীতিমতো ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এ সকল শিক্ষার্থীদের অনেকে দাবি করেছেন বাংলাদেশ থেকে বাইরে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে অন্তত শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের গতানুগতিক নিয়মের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা আরোপ করে।
হাঙ্গেরি প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সাজিন আহমেদ কৌশিক জানিয়েছেন, ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো হাঙ্গেরির অর্থনীতি পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তবে শীতের মৌসুমে খুব বেশি পর্যটকের তেমন একটা আনাগোনা না থাকায় এ সময় ইউরোপের দেশগুলোতে ট্যুরিজম খাত অনেকটা স্থবির থাকে।
তিনি জানান, তাই বছরের এ সময় এমনিতে পার্টটাইম জবের সুযোগ অনেক কমে আসে। করোনার এ সময়ে এমনিতে দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে আমরা অনেকে জব থেকে বিচ্ছিন্ন। দূতাবাসের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ কারণ এককালীন তারা আমাদেরকে কিছু অর্থ সহায়তা দিয়েছে তবে সেটা টানা কয়েক মাস চলার জন্য যথার্থ নয়।
অন্যদিকে বাইরের দেশ থেকে সহজে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানো সম্ভব হলেও বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা আনার সুযোগ অনেক কম। তাই এ পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে কীভাবে আমরা চলবো সেটা বুঝে উঠতে পারছি না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে বিদেশে তিনটি উপায়ে অর্থ পাঠানো যায়। প্রথম পদ্ধতিটির নাম হচ্ছে অ্যান্ডোর্সমেন্ট। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক ট্রাভেল কোটার আওতায় এক বছরে ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ করতে পারে।
তবে এজন্য পাসপোর্টে প্রয়োজনীয় ঘোষণা দিতে হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে এলসি। যারা ব্যবসায়ী কিংবা শিল্পপতি তারা এলসির মাধ্যমে বাইরের দেশ থেকে কোনও পণ্য কিংবা যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে আমদানি করে থাকেন। আরেকটি উপায়ে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাঠানো যায় যেটি কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য।
প্রথমে একজন শিক্ষার্থীকে কোনো একটি ব্যাংকে গিয়ে স্টুডেন্ট ফাইল ওপেন করতে হয় এবং স্টুডেন্ট ফাইলের বিপরীতে একজন শিক্ষার্থী বাইরের দেশগুলোতে কেবলমাত্র তার টিউশন ফি ও ক্ষেত্রবিশেষে তার হোস্টেলের ভাড়াও দিতে পারেন। কিন্তু এ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল এবং আমলাতান্ত্রিক বেড়াজালে পরিপূর্ণ।
এছাড়াও বাইরের দেশগুলোতে ব্যবহারের জন্য অনেকে ভিসা, মাস্টার কিংবা আমেরিকান এক্সপ্রেসের কার্ড ব্যবহার করেন তবে সবাই যে এ সকল ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করতে পারেন তেমনটিও নয়। তাই বিদেশে অবস্থানকালীন অনেকে প্রয়োজনীয় অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে হুন্ডির আশ্রয় নেন।
সেক্ষেত্রে যে বিষয়টি উঠে আসে, তা হলো নিকটস্থ কারও সন্ধান করা, যিনি বাংলাদেশে টাকা পাঠাবেন। তিনি সে টাকা বাংলাদেশে না পাঠিয়ে সরাসরি তার হাতে তুলে দেন এবং বাংলাদেশে থেকে তার পরিবারের কোনোও সদস্য ওই লোকের বিশ্বস্ত কারও কাছে এর সমপরিমাণ অর্থ পৌঁছে দেন। এতে সরকারের রেমিট্যান্স প্রবাহে ঘাটতি তৈরি হয়। এছাড়াও নৈতিক মানদণ্ডের বিষয়টি থেকেও এ হুন্ডি প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ।
অন্যদিকে ইউক্রেন প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মাসুদ বিন পারভেজ বলেছেন, কয়েকদিন আগে আমার জরুরিভিত্তিতে কিছু টাকার প্রয়োজন হয়, অনেক খোঁজাখুঁজির পরও আমি ইউক্রেন কিংবা আশপাশের দেশগুলোতে এমন কাউকে খুঁজে পায়নি যিনি দেশে টাকা পাঠাবেন।
ইতালি কিংবা ফ্রান্সে যারা আমার পরিচিত ছিল করোনার কারণে তাদের অধিকাংশই কয়েক মাস ধরে বেকার। ফলে তারাও আমাকে সাহায্য করতে পারেনি। ইউক্রেনসহ আশপাশে যে সকল দেশ রয়েছে বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর কথা যদি বলি অর্থনৈতিকভাবে এ সকল দেশ ইউরোপের অন্যান্য অংশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে।
এ সকল দেশে এখনও সেভাবে বাংলাদেশি কমিউনিটি গড়ে ওঠেনি, তাই যে কোনো বিপদে যে একজন আরেকজনের পাশে থাকবে সে অবস্থাও খুব সীমিত। তাই এ রকম পরিস্থিতিতে আমি যখন অর্থ সঙ্কটে পড়ি তখন আমাকে বাধ্য হয়ে কানাডায় থাকা আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের সাহায্যে টাকা আনতে হয় কিন্তু এভাবে টাকা আনা অনেক খরচসাপেক্ষ।
টাকা উত্তোলনের সময় বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যা রীতিমতো বিব্রতকর। তাই আমি মনে করি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করা উচিত যাতে যে কোনও কঠিন সময়ে আমরা অন্তত দেশ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য গ্রহণ করতে পারি।
মাসুদ ও কৌশিক উভয়ই মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি জরুরি প্রয়োজনে বাংলাদেশ থেকে বাইরের দেশগুলোতে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে গতানুগতিক নিয়মের পরিবর্তন আনে তাহলে হুন্ডির মতো বিষয়গুলো অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।