বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনের মুখে কয়লা পাচার–কাণ্ড গলার কাঁটা হয়ে উঠতে চলেছে তৃণমূলের। এবার এ ব্যাপারে তদন্তে অগ্রগতির জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো তথা তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে হানা দিল সিবিআই। সাংসদের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে চায় এই তদন্তকারী সংস্থা। যদিও বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন স্বয়ং অভিষেক। জানিয়েছেন, কেউ যদি ভেবে থাকে, এ ভাবে তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে, তা হলে ভুল ভাবছে। অন্যদিকে, এই ঘটনায় অভিষেককে তীব্র কটাক্ষ করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর বক্তব্য, কারও ফাঁসি তাঁরা চান না। তাঁরা চান, মানুষ প্রকৃত সত্যটা জানুক। অভিষেককে কটাক্ষ করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ও।
কয়লা–কাণ্ডে বিনয় মিশ্রকে ফেরার ঘোষণা করেছে আদালত। বিনয় তৃণমূল নেতা হিসেবে পরিচিত। আবার অভিষেক ঘনিষ্ঠও বটে। সিবিআই সূত্রে খবর, অভিষেক ঘনিষ্ঠ বিনয়ের কাছে ভারত ছাড়াও আরও ২টি দেশের পাসপোর্ট রয়েছে। কয়লা পাচার–কাণ্ডে প্রভাবশালী যোগ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এবার সিবিআই সেই যোগ খুঁজতেই সরাসরি অভিষেকের বাড়িতে হানা দিল। সিবিআই যখন ওই ঘটনার তদন্ত করে চলেছে, তখন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠছিল বিরোধী মহলে। এবার সেই পথেই পা বাড়াল সিবিআই। রবিবার দুপুরে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসভবন শান্তিনিকেতন রেসিডেন্সিতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী রুজিরা নারুলা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিশ দিয়ে এসেছেন সিবিআই আধিকারিকরা। তাঁরা অভিষেকের বাড়িতে দশ মিনিটের মতো ছিলেন।
ভারতীয় ফৌজদারি আইনের ১৬০ ধারায় সাক্ষী হিসাবে তাঁকে জেরার করার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এই ধারায় কোনও ঘটনায় কারও কাছে কোনও প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য রয়েছে বলে মনে হলে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে তদন্তকারী সংস্থা। সেই সময় অভিষেক বা রুজিরা, কেউই বাড়িতে ছিলেন না। তাই সিবিআই আধিকারিকরা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তাঁরা বাড়ি ফিরলে যেন সিবিআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অথবা, রুজিরা কখন বাড়িতে থাকবেন, তা যেন তাঁদের জানানো হয়। কোথাও হাজিরা দিতে হবে না রুজিরাকে। তাঁর সুবিধামতো সময় ও জায়গায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যেদিন তাঁরা থাকবেন, সেদিনই তাঁদের বাড়ি গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা ফোন নম্বর দিয়ে জানিয়ে যান।
উল্লেখ্য, এর আগে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করে এক জনসভায় তৃণমূল ত্যাগ করে বিজেপিতে যাওয়া নেতা শুভেন্দু অধিকারি অভিযোগ করেছিলেন, ম্যাডাম নারুলার অ্যাকাউন্ট রয়েছে থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ককের কাসিকর্ণ ব্যাঙ্কে। সেই অ্যাকাউন্টে প্রতিদিন দেড় লক্ষ থাই মুদ্রা পাঠায় লালা। এই লালা কয়লা পাচার–কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, সেই ম্যাডাম নারুলাই কি অভিষেক পত্নী রুজিরা নারুলা? এর উত্তর কিন্তু এখনও পাওয়া যায়নি। সূত্রের খবর, তদন্তে সিবিআই কিছু সূত্র পেয়েছে। তাতে তারা মনে করছে, রুজিরা নারুলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকতে পারে। তাই তারা রুজিরাকে জেরা করতে চায়।
বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও এদিন তিনি কলকাতায় ছিলেন না। টুইট করে তিনি বলেন, ‘আজ দুপুর দুটোর সময় আমার বাড়ি গিয়েছিল সিবিআই। তারা আমার স্ত্রীর নামে নোটিশ দিয়ে এসেছে। ভালো কথা। কারণ, আমাদের পুরোপুরি ভরসা রয়েছে দেশের আইনের ওপর। কিন্তু সিবিআই যদি ভেবে থাকে, এ–সব করে আমাদের ভয় দেখাবে, তা হলে বলব, তারা ভুল করছে। আমি ভয় পাই না। আমি কোনও মতেই পিছু হঠব না। এ–সব করে কেউ আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না।’ কেবল অভিষেকের স্ত্রী রুজিরাকেই নয়, তাঁর শ্যালিকা মনিকা গম্ভীরকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিশ ধরানো হয়েছে। এদিন কলকাতার পঞ্চসায়রের হাইল্যান্ড পার্কে তাঁর বাড়ি যান সিবিআই আধিকারিকরা। তবে তখন মনিকাও বাড়ি ছিলেন না। রুজিরার মতো একই ভাবে তাঁকেও নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সোমবার বেলা এগারোটায় সিবিআই আধিকারিকরা ফের সেখানে যাবেন।
এদিন বিষয়টি নিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরাসরি আক্রমণ করেছেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, ‘কে যেন বলেছিল, তাঁর সম্বন্ধে কিছু প্রমাণ করতে পারলে ফাঁসির মঞ্চে যাবেন! আমরা কারও ফাঁসি চাই না। আমরা চাই, মানুষ সত্যিটা জানুক। অন্যায় আর পাপের শাস্তি হোক। আমরা বিশ্বাস করি, পাপের শাস্তি হবেই।’ উল্লেখ্য, বিভিন্ন জনসভায় অভিষেক বলেছেন, ‘আমার পিছনে ইডি, সিবিআই লাগাতে হবে না। তোমরা একটা ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করে রাখবে। কেউ যদি আমার বিরুদ্ধে এ–সব প্রমাণ করতে পারে, আমি নিজে গিয়ে মৃত্যুবরণ করব।’ জবাবে এদিন শুভেন্দু আরও বলেছেন, ‘বিভিন্ন সভায় বড় বড় কথা বলে যাচ্ছেন। তৃণমূল থেকে যাঁরা বিজেপিতে গিয়েছেন, তাঁদের লক্ষ্য করে ওয়াশিং মেশিনের তুলনা দিয়েছেন। তিনি শুধু বড় বড় কথাই বলতে পারেন।’
প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা গায়ক বাবুল সুপ্রিয়ও। তিনি বলেছেন, ‘বেআইনি কয়লা পাচার–কাণ্ডে ইতিমধ্যে বেশ কিছু ‘কান’ ধরা শুরু হয়ে গিয়েছে। আর, সত্যি কথা বলতে কী, কান টানলে মাথা আসবেই। আসলে ঠিক মাথার কাছেই এখন সিবিআই যথাসময় পৌঁছে গিয়েছে। এখন সিবিআই তদন্ত চলছে। আমরা দেখতে চাই, সেটা টানার পর ফের কী বেরিয়ে পড়ে।’