বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : কলকাতার ব্রিগেডে লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে ‘মমতাকে জিরো করে দেব’ বলে হুঙ্কার দিলেন আব্বাস সিদ্দিকি। একই সুরে সিপিএমও তোপ দেগেছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। মহম্মদ সেলিম তীব্র আক্রমণ শানিয়ে বলেছেন, ক্ষমতায় এলে তারা ভাইপোর (পড়ুন মুখ্যমন্ত্রী ভাইপো তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়) ‘শান্তিনিকেতন’ নিলাম করে চিটফান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেবেন। যদিও বাম, কংগ্রেস ও আব্বাস সিদ্দিকির দলের জোটের তীব্র সমালোচনা করেছে তৃণমূল এবং বিজেপি।
বাম–কংগ্রেস জোটের নজিরবিহীন ব্রিগেড সমাবেশে এবার নতুন সঙ্গী ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)। ব্রিগেডে রবিবার লক্ষ লক্ষ মানুষের হাজির হওয়ার পেছনে এই দলটিই যে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল, তা এদিন কলকাতার রাস্তাঘাট দেখে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বাম কর্মী–সমর্থকদের নিয়ে কিছু বাস বা লরি ব্রিগেড অভিমুখে ছুটে গিয়েছে ঠিকই, তবে আইএসএফের কর্মী–সমর্থকদের বাস বা লরির সংখ্যার কাছে তা ছিল নগন্য। রাস্তাঘাটে এদিন আইএসএফের পতাকা লাগানো বাস বা লরির ছুটে যাওয়ার বিরাম ছিল না। দলের প্রধান নেতা আব্বাস সিদ্দিকিকেও এদিন বেশ চড়া মেজাজে পাওয়া গিয়েছে। কোনও রাখঢাকের পথে না গিয়ে ব্রিগেড থেকে সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানান তিনি। বলেন, ‘নারীদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছেন মমতা। আমরা স্বাধীনতা ফেরানোর যুদ্ধে নেমেছি। রক্ত দিয়ে মাতৃভূমিকে রক্ষা করব। মমতাকে জিরো করে দেব।’ পাশাপাশি বিজেপিকেও আক্রমণ করে তিনি হুঙ্কার দেন, ‘বিজেপির কালো হাত ভেঙে দেব।’
এদিন আব্বাস মঞ্চে উঠতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন আইএসএফ কর্মীরা। তাঁকে সমাদরে চেয়ার পর্যন্ত এগিয়ে দেন সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম। আর সেই সময়ই তাল কেটে যায় সভার। তখন মঞ্চে বক্তব্য পেশ করছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি। কিন্তু আব্বাস মঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ময়দান জুড়ে চিৎকার জুড়ে দেন তাঁর সমর্থকরা। উন্মাদনা চরমে পৌঁছয়। শোরগোল এতটাই বেড়ে যায় যে ভাষণ থামাতে হয় অধীরকে। ওদিকে আব্বাসকে তখন মঞ্চে স্বাগত জানাতে ব্যস্ত বাম নেতারা। এক সময় মহম্মদ সেলিমকে এগিয়ে এসে অধীর চৌধুরিকে কিছু বলতে শোনা যায়। দেখা যায়, বিরক্ত হয়ে বক্তব্য শেষ না করেই নেমে যেতে চান অধীর। সূত্রের খবর, তখন অধীরবাবুকে বক্তব্য সাময়িক ভাবে বন্ধ করে আব্বাসের আগমন সংবাদ ঘোষণা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন মহম্মদ সেলিম। তাতেই নাকি বিরক্ত হন অধীর। পোডিয়াম থেকে নেমে পড়তে উদ্যত হন তিনি। অবশ্য অবস্থা সামাল দেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। তাঁর অনুরোধে ফের বক্তব্য শুরু করেন অধীর।
অধীর বলেন, ‘দিদি–মোদির রাজনৈতিক ডিএনএ এক। দু’জনেই স্বৈরাচারী। গণতন্ত্রের পথে ক্ষমতায় এসে এঁরা গণতন্ত্রেরই গলা টিপে ধরেছেন।’ অধীর চৌধুরির বক্তব্য শেষ হওয়ার পরই মঞ্চে বক্তব্য পেশ করতে শুরু করেন আব্বাস। তিনি প্রথমেই বামপন্থীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তাঁরা যে কটা আসন চেয়েছিলেন, তা সহজেই ছেড়ে দিয়েছেন বাম নেতারা। বিধানসভা নির্বাচনকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। বলেন, ‘রক্ত দিয়ে আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করব। যেখানে শরিকরা প্রার্থী দেবেন, সেখানেই সব ভুলে রক্ত জল করে লড়ব। আগামিদিনে বাংলার ক্ষমতা থেকে বিজেপির বি–টিম তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করবই।’ কিন্তু রহস্যজনক ভাবে তিনি একবারও কংগ্রেসের নাম উচ্চারণ করেননি। তবে জোটের আসন সমঝোতা নিয়ে যে তিনি বিন্দুমাত্র নমনীয় হবেন না, সে কথা পরিষ্কার বুঝিয়ে দেন এদিন।
বলেন, ‘আমি স্পষ্ট বলছি, ভাগিদারি করতে এসেছি। অনেক হয়েছে, আর নয়। ভাগিদারি চাই। ভিক্ষে চাই না।’ অন্যদিকে, এদিন সন্ধেয় প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরি কিন্তু সাংবাদিকদের স্পষ্ট বলেন, ‘মালদা ও মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের জয়ী আসন রয়েছে। এই দুই জেলায় একটা আসন ছাড়া হবে না।’ ফলে জোটের ভাগ্য যে অনেকটাই অনিশ্চিত, তা কিন্তু জলের মতো স্বচ্ছ। এদিন আব্বাস বা ভাইজানের বক্তব্যে সিপিএমকে তুলনায় কিছুটা ম্লান দেখিয়েছে। তবে এই সমাবেশ তারাই ডেকেছে কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে। তাই সিপিএম নেতা ও নেত্রীদের বক্তব্যে কিন্তু যথেষ্ট ঝাঁজ ছিল। সিপিএম নেত্রী দেবলীনা হেমব্রম এদিন বলেন, ‘বিজেপি বলছে, সোনার বাংলা গড়বে। কিন্তু কাজে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল থেকে বিজেপি, আর বিজেপি থেকে তৃণমূল হচ্ছে।’ তৃণমূলকে ইঁদুরের সঙ্গে তুলনা করে তিনি কটাক্ষ করে বলেন, ‘ভোটে জিতলে ওরা কাটমানি খাবে।’ বিজেপিকে আক্রমণ করে বলেন, ‘বিজেপি ধর্মের নামে বিভাজনের চেষ্টা করছে।’
তৃণমূল ও বিজেপির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াইয়ের বার্তাও দেন তিনি। বিজেপির ‘ভোজন রাজনীতি’ নিয়েও তোপ দেগে বলেন, ‘পদ্মফুল জলেই ভালো। কিন্তু এলাকায় ফুটতে দেওয়া যাবে না। সবাই শপথ নিন।’ শেষে বলেন, ‘যে ভাবেই হোক বিজেপি–তৃণমূলকে রুখবই।’ সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমও বেশ চড়া সুরে বলেন, ‘কেউ কেউ বলল, খেলা হবে। আর মোদিজি স্টেডিয়ামই দখল করে নিলেন। বসন্ত এসে গিয়েছে। লালরঙা ফুল ফোটা কেউ আটকাতে পারবে না। ঝরা পাতার দিন শেষ। কচি পাতা উঁকি দিচ্ছে। মইদুলকে খুন করে পার পাবে না। যে বলেছিল লাল ঝান্ডা থাকবে না, সে তৃণমূলের ঝান্ডাকে ন্যাকড়া করে অমিত শাহের জুতো পালিশ করছে। এক দশক ধরে দিদি–মোদির খেলা চলছে। এ বার ওদের মাঠ থেকে নকআউট করতে হবে। এক দিকে দলবদলের লড়াই, আর এক দিলে চলছে দিনবদলের লড়াই।’
সেলিম বলেন, ‘আক্রান্ত মানুষের পাশে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম। মইদুলের বোন মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্বাস করেন না, টেট পাশ ছেলেরাও মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্বাস করেন না। কর্মহীন, অন্নহীন বাংলা তৈরি হয়েছে। যেদিন থেকে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে, সেদিন থেকেই বিভাজনের রাজনীতি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘নীল–সাদা রঙ করলেই উন্নয়ন হয় না। রাজ্যে দিদির লুঠ, কেন্দ্রে মোদির লুঠ, ওরা তোলাবাজি, কাটমানি বন্ধ করার জন্য বিজেপিতে যায়নি। লুটেরাদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে যেমন একসঙ্গে লড়তে হবে, তেমনই তাদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলেও এক হতে হবে।’ তাঁর অভিযোগ, ‘সারদায় টাকা ফেরত হয়নি। বরং যারা লুঠ করেছিল, তারা ঝপাং করে বিজেপিতে গিয়েছে। আমরা ক্ষমতায় এলে যারা লুঠ করেছে, তাদের বাড়ি, সে ভাইপোর ‘শান্তিনিকেতন’ হলেও নিলাম করব।’
সেলিম আরও বলেন, ‘শুধু ব্রিগেডে লড়াই নয়, বুথে লড়াইটা নিয়ে যেতে হবে। বুথ থেকে ভূত তাড়াব, তাপ আরও বাড়াতে হবে। আমরা এমন তাপ বাড়াব যে, তৃণমূল গলে জল হয়ে গেলেও বিজেপি বাষ্প হয়ে যাবে।’ যদিও বাম, কংগ্রেস এবং আব্বাসের আইএসএফ–এর এই জোটকে তৃণমূলের সহযোগী বলে কটাক্ষ করেছেন বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য। বলেন, ‘তৃণমূল এককভাবে ক্ষমতায় ফিরতে না পারলে উপমুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন আব্বাস সিদ্দিকি।’ তঁার দাবি, ‘সাম্প্রদায়িকতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বাম–কংগ্রেস। বিজেপির রাজনীতি সাম্প্রদায়িক আর ভাইজানের রাজনীতি অসাম্প্রদায়িক —এই তত্ত্বের বিচার করবেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। বাম জমানায় তাদের ১০ হাজার কর্মী খুন হয়েছেন বলে দাবি করেন যে কংগ্রেস নেতারা, তাদের মুখেও ‘ইনকিলাম জিন্দাবাদ’ শুনলাম। কিন্তু এত বড় ব্রিগেডে কোথাও একবারও ‘বন্দেমাতরম’ শুনলাম না।’
তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ও আব্বাসের বক্তব্য উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আব্বাসের প্রথম ভোট এটা। এখনই বড় বড় কথা বলা উচিত নয়। আগে কটা আসন জিতে দেখাক। তার পর তাঁর কথাকে গুরুত্ব দেওয়া যাবে।’ তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘মানুষকে বিভ্রান্ত করতেই কুৎসা ছড়াচ্ছেন আব্বাস। আর সিপিএমের ব্রিগেড মানেই তো টুম্পা সোনা আর আব্বাস সিদ্দিকি। সিপিএমকে আর ঘুরে দাঁড়াতে হবে না। ২০১৯ সালেও ব্রিগেড করেছিল। কী হল? ভোট তো সব বিজেপিরই ঘরে গেল।’ অন্যদিকে, আব্বাস সিদ্দিকির দলের সঙ্গে জোট করায় বাম ও কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।