বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা :
ফের সম্মুখ সমরে অমিত শাহ এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার উত্তর বাংলায়। আর দু’জনেই পরস্পরের বিরুদ্ধে তোপ দাগলেন চড়া মেজাজে। দাবি করলেন, প্রথম দু’দফায় তাঁরাই জিতছেন। ৬০টি আসনের মধ্যে অন্তত ৫০টি আসন পাচ্ছেন তঁারা। তবে অমিত শাহ দাবি করলেন, নন্দীগ্রামে মমতা হারবেন। কিন্তু মমতার দাবি, নন্দীগ্রামে তিনিই জিতছেন। সত্য জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২ মে পর্যন্ত।
শুক্রবার উত্তরবাংলা সফরে আসেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এখানে দু’টি সভা করেন তিনি। প্রথম সভাটি করেন কোচবিহারের শীতলকুচিতে, অন্যটি করেন আলিপুরদুয়ারের কালচিনিতে। দুই সভাতেই ব্যাপক জনসমাগম তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তাই তিনি তৃণমূল এবং দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তীব্র আক্রমণ শানান। প্রথমেই টেনে আনেন উন্নয়ন প্রসঙ্গ। বলেন, ‘কলকাতা থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূর উত্তরবঙ্গ। কিন্তু দিদির হৃদয়ে এর দূরত্ব ৭ হাজার কিলোমিটার। তাই এখানে আসার কথা তাঁর মনে থাকে না। তাই উত্তরবঙ্গের যে উন্নতি হতে পারত, তা হয়নি।’ কারণও তিনি বলে দেন। বলেন, ‘দিদি শুধু ভাইপোর কথা ভাবেন। তাঁরই কল্যাণের কথা সবসময় চিন্তা করেন। আপনাদের কথা এবারও ভেবে দেখেন না। উত্তরবঙ্গের কল্যাণ করতে পারেন একমাত্র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই। বাংলার ক্ষমতায় বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে উত্তরবঙ্গকে। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সব সময় অন্যায় করেছেন মমতা। এই জন্যই দিদি আপনাদের কাছে আসতে ভয় পান।’
এর পরই তিনি চলে আসেন সদ্য সমাপ্ত দুই দফার নির্বাচন প্রসঙ্গে। বলেন, ‘কাল এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, নন্দীগ্রামে দিদি হারছেন। দিদি আপনার যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। আর, দুই দফায় ৬০ আসনের মধ্যে ৫০ আসন জিতে গিয়েছে বিজেপি।’ তার পরই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় টেনে আনেন অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গ। উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনারা অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন, তাই তো? দিদি থাকলে এই সমস্যা মিটবে না। তিনিই মিটতে দেবেন না। কিন্তু বিজেপি তা নয়। রাজ্যের ক্ষমতায় বিজেপি এলে এগুলো সব বন্ধ করে দেবে। বিএসএফের সঙ্গে বসে অনুপ্রবেশকারীদের বাংলায় ঢোকা বন্ধ করে দওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন।’ এর পর উত্তর বাংলার মানুষের জন্য কী করতে পারে নতুন সরকার, সেই তথ্যও দেন। বলেন, ‘১০ হাজার কোটির কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বানানো হবে। প্রত্যেক মহিলাকে কেজি থেকে পিজি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হবে। এই কোচবিহারে এইমস (দেশের সর্বোন্নত হাসপাতাল) বানানো হবে।’
দুই দলের তুলনাও টেনে আনেন তিনি। বলেন, ‘দিদি থ্রি টি মডেলের সরকার চালাচ্ছে। এই থ্রি টি হল তানাশাহি, তোলাবাজি, তুষ্টিকরণ। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী থ্রি ভি মডেলে দেশ চালাচ্ছেন। এই থ্রি ভি হল বিকাশ, বিশ্বাস এবং ব্যাপার। এই তিন ভি–র ওপর ভিত্তি করেই আমরা কাজ করব। আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রী এই রাজ্যে রাস্তা বানানোর জন্য ২২ কোটি টাকা দিয়েছেন। কিন্তু আপনারাই বলুন রাস্তা কোথায় হয়েছে? —হয়নি। দিদিই চাননি রাস্তা হোক। এই বাংলায় ঘর বানানোর জন্য তৃণমূলকে কাটমানি দিতে হয়। ২ মে–র পর এই কাটমানি আর সিন্ডিকেট রাজ আমরা পুরোপুরি বন্ধ করে দেব। ২ মে–র পর বিনামূল্যে বাসে যাতায়াত করতে পারবেন মহিলারা।’ এদিন বিকেলে চলে আসেন দক্ষিণবঙ্গে। আরামবাগ এবং বারুইপুরে রোড শো করেন। সেখানেও রীতিমতো জনসমুদ্র ছিল। রাতেই তিনি ফিরে যান দিল্লি।
অন্যদিকে, উত্তরবাংলা অভিযানে এদিনই নেমে পড়েন তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। করেন তিনটি জনসভা। দিনহাটা, নাটাবাড়ি এবং আলিপুরদুয়ারে সভা করেন তিনি। সব সভাতেই মোটামুটি একই কথা বলেন। তাঁর কথায় উঠে আসে প্রথম দুই দফার ভোটের কথা। বলেন, ‘নন্দীগ্রামে ভোট আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি বলছি, আপনারা জয়ের দিকেই তাকিয়ে থাকুন। প্রথম দু’দফায় ৬০টি কেন্দ্রে ভোট হয়েছে। এর মধ্যে ৫০টিতে আমিই জিতছি। আর, জেনে রাখুন, নন্দীগ্রামে আমি জিতবই।’ উল্লেখ্য, মানুষের উদ্দেশ্যে এর আগে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘প্রার্থী দেখবেন না। ২৯৪টি আসনে আমিই প্রার্থী। আপনারা শুধু সমর্থন করুন।’ এদিনও তাঁর কথায় সেই ইঙ্গিত প্রকাশ পায়। পাশাপাশি তাঁর একটি কথা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে তাঁর দলেই। তিনি বলেন, ‘সরকার গড়তে হলে এখানকার প্রার্থীদেরও জেতাতে হবে। নম্বর বাড়াতে হবে। মনে রাখবেন, দুশোর বেশি আসন পেতে হবে। এখানকার প্রার্থীদের ভোট দিয়ে সেই সুযোগ করে দেবেন আপনারা। না হলে গদ্দারদের বিজেপি কিনে নেবে।’
প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি তাঁর দলের যাঁরা এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাঁদের মধ্যেও ‘গদ্দার’ রয়েছেন? রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, ‘এতদিন যাঁরা তাঁর দলে থাকতেন, তাঁরা সবাই ভালো ছিলেন। আর দল ছাড়লেই হয়ে যেতেন ‘গদ্দার’। এবার কিন্তু ভোটের আগেই নিজের প্রার্থীদের অনেকেই যে ‘গদ্দার’, তা প্রকাশ্য সভায় স্বীকার করে নিলেন! প্রকাশ্যে কিছু না বলেও বিষয়টি নিয়ে দলের অনেক নেতাই অখুশি হবেন।’ এর পর তিনি আক্রমণ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে। তিনি বলেন, ‘এবারের নির্বাচন তো পরিচালনা করছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে আমাদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়েছেন।’ এর পর কিছুটা হুমকির সুরে তৃণমূল প্রার্থীদের ডেকে বলেন, ‘তোমরা আমাকে নিশ্চিত করো, প্রতিবাদ করবে। যদি আগের দিন ওরা তাণ্ডব করে, তোমরাও পাড়ায় পাড়ায় যাবে। দেখি কত সিআরপিএফ, বিএসএফ, কেন্দ্রীয় বাহিনী তোমাদের গ্রেফতার করে। মনে রাখবে, আমি দুর্বল ছেলেমেয়ে চাই না। আমি চাই এমন ছেলেমেয়ে, যারা বিজেপির, টাকার জোর, গায়ের জোরের সঙ্গে লড়াই করবে।’
এর পর সাধারণ জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘ভোটের জন্য চুপ করে আছি। আমি সিআরপিএফ, বিএসএফকে সম্মান করি। কিন্তু ওরা তাণ্ডব করেছে। ওদের কাছে আমার অনুরোধ, বিজেপির কথায় অত্যাচার করা বন্ধ করুন। নন্দীগ্রামে আমার নেতাদের বাড়িতে ঢুকে তাণ্ডব করেছে। মনে রাখবেন, ওরা যদি তাণ্ডব করেন, তা হলে আপনারাও জবাব দেবেন, প্রতিবাদ করবেন।’ তাঁর কথার মধ্যে হুমকির সুর রয়েছে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
আরও পড়ুন : পশ্চিমবঙ্গে ৬ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারে এপ্রিলের গরম