ফুলবিজুর দিন:
করোনামুক্তি লাভের জন্য সকালে রাঙ্গামাটি কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনা জানালো হিলর প্রোডাকশন’র সদস্যরা।
চৌধুরী হারুনুর রশীদ,রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি :
বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ সংক্রমণ আতঙ্কের মধ্যে পাহাড়ে শুরু হয়েছে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর তিন দিনব্যাপী উৎসববিহীন বিজু। রোববার পালিত হয়েছে ফুলবিজু। সকালে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই মহান সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে পানিতে ফুল ভাসিয়ে নিবেদন করা হয় পুস্পাঞ্জলি। এ ছাড়া সকালে বিহারসহ নিজ বাড়িতে বৌদ্ধমূর্তি পরিষ্কার ও সকাল-সন্ধ্যায় পাহাড়িদের ঘরে ঘরে জ্বালানো হয়েছে মঙ্গল প্রদীপ। প্রার্থনা জানানো হয়েছে, বৈশ্বিক মহামারী করোনাসহ যাবতীয় ভয়, অন্তরায়, বাধা-বিপত্তি, দুঃখ-গ্লানির বিনাশন করে নতুন বছরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যাতে পৃথিবীর গোটা মানবজাতির অনাবিল সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠা লাভ হয়।
সোমবার(১২এপ্রিল) সকালে বিশ্ব শান্তি মঙ্গল প্রার্থনা ও করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশে রাঙ্গামাটি বিজয় নগর এলাকায় কাপ্তাই হ্রদের জলে ফুল ভাসিয়ে সীমিত পরিসরে তিনদিন ব্যাপী বিজু উৎসবের শুরু হয়েছে। সকালে ‘হিলর প্রোডাকশন বিজু উৎযাপন কমিটি ২০২১’ এর উদ্যোগে রাঙ্গামাটিতে ভাসানো হয়েছে নানান রঙের ফুল। এসময় ফুল ভাসানো অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ‘হিলর প্রোডাকশন বিজু উৎযাপন কমিটি ২০২১’ এর আহ্বায়ক জীবন চাকমা, রাঙ্গামাটি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নন্দন দেবনাথ, প্রেস ক্লাবের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক হিমেল চাকমা, প্রেস ক্লাবের সদন্য ও হিলর প্রোডাকশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সুপ্রিয় চাকমা শুভ, মগবান ইউনিয়ন পরিষদের সচিব অমৃত লাল চাকমাসহ হিলর প্রোডাকশন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্য প্রমূখ।
এদিকে করোনার কারণে এবার রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় কোথাও কোনো উৎসবের উচ্ছ্বাস, আমেজ নেই। সব জায়গায় নীরব-নিস্তব্দতা। কেবল ঐতিহ্যবাহী সামাজিক রীতিনীতি পালন করতেই রোববার থেকে উদযাপিত হচ্ছে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোর তিন দিনব্যাপী প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু। প্রত্যেক বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বাংলাবর্ষ বিদায় এবং বরণ উপলক্ষে এ উৎসবটি পালন করে পাহাড়িরা। চাকমারীতি অনুযায়ী সোমবার পালিত হয়েছে ফুলবিজু। এরপর মূলবিজু পরের বার গোজ্জেপোজ্জে দিন পালিত হবে, যার যার ঘরে।
উৎসবটিকে চাকমারা বিজু ছাড়াও মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক নামে পালন করে। এর প্রথম দিন চাকমারা ফুলবিজু, মারমারা পাইংছোয়াই, ত্রিপুরারা হারিবৈসুক, দ্বিতীয় দিন চাকমারা মুলবিজু, মারমারা সাংগ্রাইং আক্যা, ত্রিপুরারা বৈসুকমা এবং তৃতীয় দিন চাকমারা গোজ্যেপোজ্যে দিন, মারমারা সাংগ্রাই আপ্যাইং ও ত্রিপুরারা বিসিকাতাল নামে পালন করে থাকে ঘরে ঘরে। এটি পাহাড়ি জনগণের প্রাণের উৎসব। প্রত্যেক বছর উৎসবে প্রাণে প্রাণে তৈরি হয় উচ্ছ্বাসের বন্যা। সম্মিলন ঘটে পাহাড়ে বসবাসকারী সব জাতিগোষ্ঠী মানুষের। কিন্তু এবার উৎসবকে কেড়ে নিল প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাস।
দেখা গেছে, করোনার কারণে এবারই প্রথম পাহাড়ে কোনো ‘বিজু’ পালন করতে হচ্ছে, উৎসব ছাড়াই। যুগযুগ ধরে প্রত্যেক বছর বিপুল আনন্দঘন পরিবেশে উৎসবটি’ পালন করে আসছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এবার করোনার প্রভাবে উৎসব ছাড়াই যার যার ঘরে কেবল পরিবারের মধ্যেই পালন করতে হবে ‘বিজু’। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে শহর থেকে শুরু করে গ্রাম, পাড়া, মহলা পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলার সব জায়গায় যার যার বাড়িঘরে নিরাপদে অবস্থান করছে মানুষ। এ পরিস্থিতিতে কেবল যার যার পরিবারের মধ্যে পাহাড়িরা পালন করছে বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক। করোনার কারণে এবার কোনা রকম আনুষ্ঠানিকতা নেই। নেই কোনো উৎসব।
প্রত্যেক বছর উৎসবটিকে ঘিরে রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং সরকারি বেসরকারি সংস্থা ব্যাপক কর্মসূচির আয়োজন করে থাকে। এসব বর্ণাঢ্য কর্মসূচির মধ্যে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, গ্রামীণ পালাগান, র্যাফেল ড্র লটারি, পাজন ও পিঠা উৎসব, নিজস্ব সংস্কৃতির প্রদর্শনী, নাট্যমঞ্চ, চলচ্চিত্র, সাময়িকী প্রকাশনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। জানুয়ারি থেকেই এসব কর্মসূচি গ্রহণের প্রস্তুতি শুরু হয়। এবারও পূর্ব থেকে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেও বৈশ্বিক প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে তা বাতিল করতে হয়েছে বহু সংগঠনকে।
‘হিলর প্রোডাকশন বিজু উৎযাপন কমিটি ২০২১’এর আহ্বায়ক জীবন চাকমা বলেন, ‘গত বছরে করোনাভাইরাসের আতঙ্কে পাহাড়ে বিঝু উৎসব করা হয়নি। এবারে সরকারের স্বাস্থ্যবিধি নির্দেশনা মেনে পাহাড়ে সীমিত আকারে বিঝু উৎসব পালিত হবে। সোমবার সকালে কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়ে শুরু হবে বিঝু উৎসব। তবে সবকিছু হবে জনসমাগম ছাড়া। এছাড়াও বিঝু উৎসবের প্রধান আর্কষণ ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার আয়োজন করা হবে না।
বিঝু,সাংগ্রাইং,সাংক্রান,সাংক্রাই,বৈসু,বিষু, বিহু ২০২১ উদযাপন কমিটির সদস্য ও পার্বত্য অঞ্চলের বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ইন্টুমনি তালুকদার বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাসহ সব ধরনের প্রস্তুতি স্থগিত করা হয়েছে। তবে বিঝু উৎসবের প্রকাশনা বাহির হবে। শুধু তাই নয়,স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে নিজ নিজ বাড়িতে বিঝু উৎসব আয়োজনের জন্য বলা হয়েছে।
এদিকে সরকারের স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকল প্রকার জনসমাগম ছাড়াই নিজ নিজ বাড়িতে পরিবারের স্বজনদের সাথে বিঝু উৎসব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, জনসমাগম যাহাতে না হয় সব সময় খেয়াল রাখতে হবে। একজনের বাড়িতে অন্য পরিবারের লোকজন যাহাতে না আসে তার গুরুত্ব দিতে হবে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে বড়ধরনের আয়োজন,উৎসব থাকলে তা অনলাইনে করতে হবে।
আরও পড়ুন : যে কারণে হ্যাকারদের কবলে পড়তে পারে কম্পিউটার