বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: শীতলকুচির ঘটনায় এফআইআর দায়ের হল তৃণমূল নেত্রীর বিরুদ্ধে। তারই মধ্যে বুধবার সেখানে যান মমতা। তাঁর মঞ্চে হাজির হলেন নিহতদের পরিবারগুলিও। যদিও সেই মঞ্চে যাওয়ার আমন্ত্রণ আগেই উড়িয়ে দেয় নিহত আনন্দ বর্মণের বাবা–মা। অবশ্য সেখানে হাজির ছিলেন আনন্দের দাদু ও মামা। তবে তাঁদের ভয় দেখিয়ে জোর করে সেখানে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ করেছেন স্বয়ং নিহত আনন্দের দাদু।
তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হল কোচবিহারের মাথাভাঙা থানায়। কোচবিহার জেলার বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি সিদ্দিক আলি মিঁয়া এই এফআইআর দায়ের করেছেন। তাঁর অভিযোগ, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করে ভোট দিতে যাওয়ার উসকানি দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁর উসকানিতেই সেখানকার তৃণমূল মহিলা এবং পুরুষরা হাতা–খুন্তি, লাঠিসোঁটা নিয়ে ঘেরাও এবং আক্রমণ করে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। বাহিনী পাল্টা গুলি চালালে প্রাণ যায় চারজনের। এই ঘটনার জন্য পুরোপুরি দায়ী মমতাই। তাঁর দাবি, এখনই গ্রেফতার করতে হবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ৭ এপ্রিল কোচবিহারের শীতলকুচিতে একটি নির্বাচনী জনসভা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ওই সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘কেন্দ্রীয় বাহিনী যদি গন্ডগোল করে, তা হলে মহিলারা একদল গিয়ে তাঁদের ঘেরাও করুন। আরেক দল ভোট দিতে যাবেন।’ তার পরই ১০ এপ্রিল ভোটের দিন ঘটে সেই মর্মান্তিক ঘটনা।
উল্লেখ্য, মমতার জনসভার পরই বিজেপি তাঁর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনে নালিশ জানিয়েছিল। কমিশনও পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে মমতাকে কড়া চিঠি পাঠিয়ে ১০ এপ্রিলের মধ্যে জবাব চায়। মমতা কমিশনের চিঠির জবাবে জানিয়েছিলেন, তিনি কোনও উসকানি দেননি। ঘেরাও করা মানে আক্রমণ নয়, ঘেরাও মানে কথাবার্তা। এটি প্রতিবাদের আরেকটি রূপ। দীর্ঘদিন ধরে বাংলার রাজনীতিতে এই ঘেরাও শব্দ চলে আসছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে তিনি শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু ১০ এপ্রিল ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর তোলপাড় হয়ে যায় বাংলার রাজনীতি। ১১ এপ্রিল তৃণমূল নেত্রী শীতলকুচিতে যাবেন বলে ঠিক করেন। কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের তরফে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, ৭২ ঘণ্টা সেখানে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিই যেতে পারবেন না। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আরও একটি ঘটনা ঘটে। জনপ্রতিনিধি আইন মেনে ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চাওয়ার অভিযোগ মমতাকে শো–কজ করেছিল কমিশন। মমতা জবাবও দেন। কিন্তু কমিশন সেই উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ২৪ ঘণ্টার জন্য তাঁর প্রচার নিষিদ্ধ করে।
ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গে প্রচারে গিয়ে মমতাকে নিশানা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ। নিহত ৪ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বলেই তিনি তাঁদের পরিবারের কাছে যাচ্ছেন। অথচ সেদিনই ভোটের লাইনে আনন্দ বর্মন নামে আরও একজনকে গুলি করে খুন করা হয়। তিনি রাজবংশী বলে তাঁর মৃত্যুর জন্য শোক প্রকাশের প্রয়োজন বোধ করছেন না তিনি। এই অভিযোগের কাটাতে উদ্যোগী হন তৃণমূল নেত্রী। এদিন নিহত ৫ জনের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন মমতা। সেই পরিবারগুলির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন নিহত আনন্দের দাদু ক্ষিতীশচন্দ্র রায় এবং মামা জগদীশচন্দ্র রায়। যদিও পরে আনন্দের দাদু ক্ষিতীশচন্দ্র রায় পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাকে জোর করে মমতার মঞ্চে নিয়ে গিয়েছিল তৃণমূলের গুন্ডারা। ওখানে গিয়ে কী বলতে হবে, তা তারা আমাকে বলে দিয়েছিল। ভয়ে তারা যা বলেছে, সেই মতোই কথা বলেছি। জেলা তৃণমূল নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেছিলেন, মমতার কাছে সরকারি চাকরি চাইতে। ভয়ে আমি সে কথাই বলেছি।’
কিন্তু তার আগেই নিহত আনন্দ বর্মনের দাদু ও মামার এই সাক্ষাতের ঘটনা নিয়ে রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করেন নিহত আনন্দ বর্মনের মা ও বাবা। আনন্দের মা বাসন্তী দেবী বলেন, ‘বাবা আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে এবং না জানিয়েই ওখানে গিয়েছেন। তিনি সরাসরি রাজনীতি না করলেও বিজেপিকেই ভোট দেন। আমার ছেলে আনন্দও বিজেপি করত। তবে আজ আমার বাবাকে তৃণমূলের গুন্ডারা ভয় দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমরা তৃণমূলের দেওয়া কোনও সাহায্যই নেব না।’ আনন্দের বাবা জগদীশ বর্মন বলেছেন, ‘আনন্দের দাদুকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ছেলে আমার। আমি যে সিদ্ধান্ত নেব, তা–ই হবে। তৃণমূলই আমার ছেলেকে মেরেছে। আমরা এই তৃণমূলের কোনও সাহায্য নেব না। আমরা তাদের কোনও সাহায্য চাই না। রাজ্যে সরকার পরিবর্তন হলে নতুন সরকার সাহায্য করলে তবেই সেই সাহায্য নেব।’
যদিও নিহত অপর ৪ পরিবারের সদস্যরা স্বাভাবিক ভাবেই হাজির হয়েছিলেন মমতার মঞ্চে। তৃণমূলের দেওয়া সাহায্য তাঁরা নেবেন বলেও জানিয়েছেন। পরে শীতলকুচিতে মমতার যাওয়া নিয়ে বিজেপি নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার তোপ দেগে বলেন, ‘শীতলকুচিতে মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করছেন মমতা। নিহত আনন্দদের পরিবারে ভাঙন ধরিয়ে দাদুকে ভয় দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁর সভায়। বাংলার মানুষ তাঁর এই ভণ্ডামো মেনে নেবে না।’
আরও পড়ুন : ভারতে ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড শনাক্ত ১৮৪৩৭২, মৃত্যু ১০২৭