রাজ্যপালের অপসারণ চেয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি মমতার
বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
নারদ–কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া চার প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে বেশ কড়া অবস্থানই নিচ্ছে সিবিআই। এ জন্য কোনও রকম শিথিলতা তারা দেখাবে না বলেও জানা গিয়েছে। অন্যদিকে, ধৃত নেতারাও মঙ্গলবার হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁদের আবেদন, জামিনের যে রায়ে স্থগিতাদেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ, তা যেন পুনর্বিবেচনা করা হয়। ধৃতদের তরফে এদিন হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি, সিদ্ধার্থ লুথরা এবং কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা হাইকোর্ট তাঁদের আবেদন গ্রহণ করেছে। তবে মঙ্গলবার ওই মামলার শুনানি করতে রাজি হয়নি। জানিয়ে দিয়েছে, বুধবার হবে সেই শুনানি। ফলে মঙ্গলবারও কার্যত জেল হেফাজতেই থাকতে হচ্ছে ধৃত নেতাদের।
বুধবার কলকাতা হাইকোর্টে দুটি মামলারই একসঙ্গে শুনানি হবে। একটি জামিনের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশের পুনর্বিবেচনা করা এবং অপরটি সিবিআইয়ের আবেদন। উল্লেখ্য, রাজ্যে এই মামলার তদন্তকাজ যে সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব নয়, তা হাইকোর্টে সোমবার রাতেই জানিয়ে দিয়েছে এই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। উল্লেখ্য, ধৃতদের গ্রেফতারি আটকাতে সোমবার সকালে নিজাম প্যালেসে গিয়ে ধর্না দিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। শুধু তাই নয়, তাঁদের গ্রেফতার করতে হলে তাঁকেও গ্রেফতার করতে হবে বলে তিনি হুমকি পর্যন্ত দেন। এই ঘটনাকেই সিবিআই এবার আদালতে ইস্যু করেছে।
সিবিআইয়ের প্রশ্ন, একটি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান যদি এমন কাজ করেন, তা হলে সেই রাজ্যে কী করে নিরপেক্ষ ভাবে তদন্তের কাজ করা যাবে? তা ছাড়া, যে ভাবে গোটা রাজ্যে শাসক দলের তরফে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে, নিজাম প্যালেসে যে ভাবে পাথর ছোড়া হয়েছে, এমনকী রাজভবনের সামনেও শাসক দলের অসংখ্য কর্মী যে ভাবে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, তাতে এই রাজ্যে তদন্ত প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ ভাবে এগোবে না বলেই মনে করছে তারা। তাদের বক্তব্য, এ থেকেই বোঝা যায়, ধৃত চার নেতা কতখানি প্রভাবশালী! তাই এই রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে মামলা নিয়ে যেতে চায় তারা। পাশাপাশি ধৃতদের ১৪ দিনের জন্য জেল হেফাজতেও রাখতে চায়। বুধবার এই দুটি মামলারই শুনানি হবে হাইকোর্টে।
এখানেই থেমে থাকেনি সিবিআই। তারা পুরো রিপোর্ট বিস্তারিত ভাবে সুপ্রিম কোর্টকেও জানাবে। সেই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে আগাম আবেদন করে যাতে অভিযুক্তরা একতরফা শুনানি চালাতে না পারেন, তাই শীর্ষ আদালতে ক্যাভিয়েটও দাখিল করেছে সিবিআই। এ ছাড়া দিল্লিতে সিবিআইয়ের সদর দফতরেও এই রিপোর্ট, ভিডিও ফুটেজ–সহ পাঠানো হচ্ছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকেও এই রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে। অর্থাৎ, একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এমন আইনবিরুদ্ধ আচরণকে মোটেও সহজ ভাবে নিচ্ছে না সিবিআই।
এদিকে, রাতে গ্রেফতার হওয়ার পরই জেলে গিয়ে ধৃত নেতাদের অসুস্থতার খবর আসতে থাকে। প্রথমে শোনা যায় শোভন চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম এবং মদন মিত্র নাকি অসুস্থ। তাদের এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। যদিও মঙ্গলবার সকালে জানা যায়, ফিরহাদ হাকিম মোটামুটি ভালোই আছেন। তবে শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং মদন মিত্র অসুস্থ। এ ছাড়া মঙ্গলবার সকালে অসুস্থ বোধ করেন রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। হাসপাতালে তাঁর কিছু শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। তাঁর পরিবারের তরফে তাঁকে হাসপাতালে রাখার আবেদন জানানো হয়েছে। তবে তাঁদের মধ্যে কতজন সত্যিই অসুস্থ, তা নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কোনও কোনও নেতা প্রশ্ন তুলেছেন। অবশ্য তা নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি। রাতের খবর, মদন মিত্র এবং শোভন চট্টোপাধ্যায় অনেকটাই সুস্থ।
এদিকে, এদিন ভোররাতে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের বিরুদ্ধে রাজভবনের সামনে অভিনব বিক্ষোভ দেখান এক যুবক। তিনি বেশ কিছু ভেড়া নিয়ে হাজির হন রাজভবনের সামনে। যদিও তাঁকে রাজভবনের সামনে থেকে সরিয়ে দেয় পুলিশ। পাশাপাশি, রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে পশ্চিমবাংলা থেকে সরিয়ে নেওয়ার আবেদন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠি লিখেছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। জানিয়েছেন, রাজ্যের সমস্ত কাজে বাধা দিচ্ছেন রাজ্যপাল। সবসময় রাজ্য এবং মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করছেন, রাজ্যের মতামতের তোয়াক্কা না করেই যে কোনও জায়গায় চলে যাচ্ছেন। তবে ওয়াকিবহাল মহলের মতে, মুখ্যমন্ত্রী নিজেও জানেন, তাঁর আবেদন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, কেউই গ্রহণ করবেন না। এ ছাড়া রাজ্য বিধানসভায় রাজ্যপালের অপসারণ চেয়ে প্রস্তাবও পাস করাতে পারে তৃণমূল সরকার। যদি এই ঘটনা ঘটে, তা হলে তা হবে নজিরবিহীন।
এদিকে, শুভেন্দু অধিকারী এবং মুকুল রায়কে কেন গ্রেফতার করা হয়নি, তা নিয়ে মঙ্গলবারও প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল নেতারা। এ বিষয়ে এদিন মুখ খুলেছেন স্বয়ং ম্যাথু স্যামুয়েলও। শুভেন্দু অধিকারীকে গ্রেফতার করা উচিত ছিল বলে এদিনও তিনি মন্তব্য করেন। তবে মুকুল রায় প্রসঙ্গে বলেন, ‘তিনি আমার কাছ থেকে টাকা নেননি।’ বিষয়টি নিয়ে এদিন সিবিআইয়ের বক্তব্যও জানা গিয়েছে। তাদের বক্তব্য, মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে তাদের হাতে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ নেই। তাই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়নি। তা হলে শুভেন্দু অধিকারীকে গ্রেফতার করা হয়নি কেন? এই প্রশ্নের জবাবে সিবিআইয়ের বক্তব্য, ঘটনার সময় শুভেন্দু অধিকারী সাংসদ ছিলেন। তাই তাঁকে গ্রেফতার করতে হলে লোকসভার অধ্যক্ষের অনুমতি নিতে হবে। তাদের সেই আবেদন এখনও লোকসভায় আটকে রয়েছে। সেইজন্য শুধু শুভেন্দু অধিকারী কেন, সৌগত রায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের অন্য অভিযুক্ত সাংসদদেরও গ্রেফতার করা যায়নি।
অন্যদিকে, নারদ বিতর্কের মাঝেই বিজেপি নেতা তথা নন্দীগ্রামের বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে খবর। তবে কী কারণে তিনি দিল্লি যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। কিন্তু এদিন মুকুল রায়ের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। সারাদিন তিনি লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গিয়েছেন। আবার, এদিনই মুখ খোলেন অমিতাভ চক্রবর্তী। উল্লেখ্য, নারদ–কাণ্ড নিয়ে ২০১৭ সালে তিনিই জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন। এদিন সন্ধ্যায় এক লিখিত বিবৃতিতে তিনি জানান, সিবিআইয়ের উচিত সবাইকেই চার্জশিট দেওয়া।