বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
ইস্তফা দিলেন ভবানীপুরের তৃণমূল বিধায়ক তথা কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। মনে করা হচ্ছে, ওই কেন্দ্রে উপনির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে এই কেন্দ্র থেকেই বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন মমতা। কিন্তু এ বছরের বিধানসভা নির্বাচনে তিনি নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী হন। কিন্তু ওই কেন্দ্রে তিনি বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে পরাজিত হন। তার পরেও তিনিই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন। তাই নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে ছ’মাসের মধ্যে রাজ্যের কোনও একটি আসন থেকে জিতে বিধানসভায় আসতে হত। তৃণমূল সূত্রে খবর, নিজের কেন্দ্র ভবানীপুর থেকেই উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন মমতা।
শুক্রবার পদত্যাগের পরে শোভনদেব বলেন, ‘দলের নির্দেশে আমার এই সিদ্ধান্ত। আমি দলের অনুগত সৈনিক।’ পরে তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে জানান, দলনেত্রীকে আসন ছেড়ে দিতেই তিনি ইস্তফা দিচ্ছেন। তৃণমূলের দীর্ঘদিনের নেতা শোভনদেব। আগাগোড়া মমতার ঘনিষ্ঠ হিসেবেই রাজনৈতিক জগতে পরিচিত। তিনিই তৃণমূলের প্রথম বিধায়ক। তৃণমূল তৈরি হওয়ার আগে তিনি দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরের কংগ্রেস বিধায়ক ছিলেন। তৃণমূল তৈরি হওয়ার পর ১৯৯৮ সালে বারুইপুরের বিধায়ক পদ ছেড়ে দেন। তৃণমূল প্রার্থী হন রাসবিহারী কেন্দ্রে বিধানসভার উপনির্বাচনে। কংগ্রেস বিধায়ক হৈমী বসুর মৃত্যুতে ওই কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়। সেই উপনির্বাচনে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জয়ী হয়ে বিধায়ক হন।
সেই প্রথম তাঁর মাধ্যমেই রাজ্যের বিধানসভায় আত্মপ্রকাশ করে তৃণমূল। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও রাসবিহারী কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু এবারের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রাম থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ঘোষণা করে দিলে, ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে তৃণমূল প্রার্থী কে হবেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। তখন রাসবিহারী থেকে সরিয়ে শোভনদেবকে ভবানীপুরে প্রার্থী করা হয়। এই কেন্দ্রে তিনি বিজেপি প্রার্থী রুদ্রনীল ঘোষকে হারিয়ে দেন।
সূত্রের খবর, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে এবার রাজ্যসভায় নিয়ে আসতে চান মমতা। রাজ্যসভায় এখন তৃণমূলের দুটি আসন ফাঁকা রয়েছে। দীনেশ ত্রিবেদী বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি–তে যোগ দিয়ে রাজ্যসভার সাংসদ পদে ইস্তফা দেন। এ ছাড়া মানস ভুঁইয়া রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। বিধানসভা নির্বাচনে মমতা তাঁকে সবং কেন্দ্র থেকে তৃণমূল প্রার্থী করেন। ওই কেন্দ্রে নির্বাচিত হয়ে তিনি বিধানসভায় এসেছেন। তাই রাজ্যসভার সদস্য পদে ইস্তফা দেন তিনি। কিন্তু তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যসভার প্রার্থী হতে ইচ্ছুক নন শোভনদেব। দলকে সে কথা জানিয়েও দিয়েছেন।
দলকে তিনি জানিয়েছেন, তিনি কৃষিমন্ত্রী হিসেবেই কাজ করে যেতে চান। শোনা যাচ্ছে, এই অবস্থায় খড়দা বিধানসভা কেন্দ্রে শোভনদেবকে প্রার্থী করতে পারে তৃণমূল। উল্লেখ্য, এই কেন্দ্রে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী ছিলেন কাজল সিনহা। কিন্তু ভোটগ্রহণের পর, কিন্তু ফল ঘোষণার আগে করোনা সংক্রমিত হয়ে কাজল সিনহা প্রয়াত হন। কিন্তু ওই কেন্দ্রে তিনি জয়ী হন। তাই ওই কেন্দ্রে ফের নির্বাচন হবে। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, এই কেন্দ্রেই হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী হবেন। কিন্তু এদিন রাত পর্যন্ত যা খবর, তাতে মনে হচ্ছে, শোভনদেবকেই ওই কেন্দ্রে প্রার্থী করতে পারে তৃণমূল।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে পশ্চিমবংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান হয়। ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। তখন মমতা ছিলেন লোকসভার সাংসদ। কিন্তু সাংসদ পদে ইস্তফা দিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হন। তাই ৬ মাসের মধ্যে তাঁকে কোনও বিধানসভা আসন থেকে জিতে আসতে হত। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভবানীপুর কেন্দ্রের বিধায়ক হন সুব্রত বকসি। কিন্তু মমতাকে তিনি আসনটি ছেড়ে দেন। ওই কেন্দ্রে উপনির্বাচনে জিতে এসে মুখ্যমন্ত্রীর পদটি ধরে রাখেন মমতা। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও এই কেন্দ্র থেকে ভোটে প্রার্থী হন তিনি। এবং জয়ী হন। ওই কেন্দ্রে মমতা পান ৬৫ হাজার ৫২০টি ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি পান ৪০ হাজারের কিছু বেশি ভোট।
কিন্তু হিসেব বদলে যায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। এই নির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল প্রার্থী হন মালা রায়। এই লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যেই পড়ে ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রটি। ভবানীপুরে মালা রায় তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থী চন্দ্রকুমার বসুর চেয়ে এগিয়ে ছিলেন মাত্র ৩ হাজার ১৬৮টি ভোটে। সবাইকে চমকে দিয়ে এই কেন্দ্র থেকে চন্দ্রবাবু পান ৫৭ হাজার ৯৬৯টি ভোট। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নিজের কেন্দ্রে তৃণমূলের রং এ ভাবে ফিকে হয়ে যাওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েন স্বয়ং দলনেত্রীই। অনেকে মনে করেন, সেইজন্য তিনি এবারের বিধানসভা নির্বাচনে ভবানীপুরে প্রার্থী হওয়ার ঝুঁকি নেননি। যদিও নন্দীগ্রামে প্রার্থী হয়েও তাঁর লাভ হয়নি। সেখানেও হারতে হয়েছে তাঁকে।
১৯৫২ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে টানা ভোট হয়েছে। কিন্তু ১৯৭২ সালের পর এই কেন্দ্রের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে ডিলিমিটেশন কমিশন সুপারিশ করলে ২০১১ সালে এই ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্র ফের ফিরে আসে স্বতন্ত্র কেন্দ্র হিসেবে। এই কেন্দ্র বরাবরই দক্ষিণপন্থী ভাবধারা ঘেঁষা বলে পরিচিত। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জমানায় একবারও এই কেন্দ্রে বামেরা জয়ী হতে পারেনি। মাত্র একবারই এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিলেন বামপন্থীরা। সেটা ১৯৬৯ সালে। সেবার এই কেন্দ্র থেকে জিতে বিধায়ক হন সিপিএমের সাধন গুপ্ত। বাকি নির্বাচনগুলিতে এই কেন্দ্রে জিতে এসেছে কংগ্রেস। তবে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই কেন্দ্রে তৃণমূলেরই রমরমা।