বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: রহস্যমৃত্যু তরুণ বিজেপি কর্মী দেবাশিস আচার্যর। ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জুড়ে। পুলিশের বক্তব্য, দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তাঁর। তবে এই দুর্ঘটনার তত্ত্ব মানতে রাজি হয়নি দেবাশিসের পরিবার। পরিবারের সদস্যরা জোর গলায় খুনের অভিযোগ তুলেছেন। তাঁকে খুন করা হয়েছে বলে একই অভিযোগ করেছে বিজেপিও। তারা আঙুল তুলেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। যদিও সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল।
তথ্য বলছে, পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরে তৃণমূলের জনসভা ছিল ২০১৫ সালে। সেই সভার অন্যতম বক্তা ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চের সামনে বসেছিলেন তৃণমূল কর্মীরা। অভিষেক মঞ্চে উঠলে তাঁকে ঘিরে ভিড় হয়ে যায়। মঞ্চের সামনে বসেছিলেন দেবাশিস আচার্যও। তরুণ তৃণমূল কর্মী। তিনিও অভিষেককে ঘিরে থাকা ভিড়ের মধ্যে উঠে যান। সেই সময় আচমকাই অভিষেককে চড় মারেন তিনি। ঘটনায় পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক মহলে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল তখন। পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁকে। যদিও পরে জামিন পেয়ে যান তিনি। সূত্রের খবর, সেই ঘটনাকে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বলে উল্লেখ করেছিলেন রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ। সেই সময় দেবাশিস রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারীর অনুগামী ছিলেন। রাজনীতিতে তখন অভিষেক এবং শুভেন্দু আলাদা গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন। একই দলের মধ্যে থেকেও শুভেন্দুর সঙ্গে তখন অভিষেকের বেশ দূরত্ব ছিল। তাঁদের দ্বন্দ্বেই ওই ঘটনা ঘটেছিল বলে অনেকে মনে করেন।
এখন শুভেন্দু অধিকারী বিজেপি নেতা শুধু নন, নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করে নিজের দাপট বুঝিয়ে দিয়েছেন। শুভেন্দুর পথ অনুসরণ করে দেবাশিসও বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বিধানসভা নির্বাচনের আগে আরেক বিজেপি নেতা কনিষ্ক পাণ্ডা হুমকি দিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেই সময় কনিষ্কের পাশে নাকি দেখা গিয়েছিল এই দেবাশিসকেই। এই ঘটনা নিয়েও রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক কম হয়নি। সেই দেবাশিসেরই রহস্যজনক মৃত্যু হল বৃহস্পতিবার। এদিন তমলুক থানার ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কের সোনাপাটিয়া টোলপ্লাজা থেকে কিছুটা দূরে অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তার পাশে দেবাশিসকে পড়ে থাকতে দেখেন অজ্ঞাত পরিচয় কিছু ব্যক্তি। তাঁরাই নাকি তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান। তার পর অবশ্য তাঁদের কাউকে আর দেখা যায়নি। হাসপাতাল থেকে খবর যায় তমলুক থানায়। সেখান থেকে পুলিশ যায় হাসপাতালে। তার পর হাসপাতালেই মৃত্যু হয় দেবাশিসের।
পুলিশ জানিয়েছে, দুর্ঘটনাতেই দেবাশিস আহত হয়েছিলেন। পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান। এদিকে, জানা গিয়েছে, একদিন আগে থেকে দেবাশিস নাকি নিখোঁজ ছিলেন। তাঁর এক বন্ধু জানিয়েছেন, বুধবার সন্ধেয় একসঙ্গেই ছিলেন তাঁরা। হঠাৎ একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা বলে চলে যান দেবাশিস। দ্রুত ফিরে আসবেন বললেও আসেননি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তাঁরা যে যাঁর বাড়ি ফিরে যান। এরপর গোটা রাত পেরিয়ে গেলেও বাড়ি ফেরেননি দেবাশিস। কিন্তু পুলিশের বক্তব্য মানতে রাজি হয়নি দেবাশিসের পরিবার। দেবাশিসকে খুন করা হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেছে। দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়ারও দাবি জানিয়েছে তারা। এ ব্যাপারে দেবাশিসের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে বিজেপিও। বিজেপির তরফে অভিযোগ করা হয়েছে, পরিকল্পিত ভাবে খুন করা হয়েছে দেবাশিস আচার্যকে। তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। যদিও তৃণমূল সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। তারা গোটা ঘটনার তদন্ত দাবি করেছে।
উল্লেখ্য, গত পাঁচ বছর ধরে রাজ্য জুড়ে বহু বিজেপি নেতা ও কর্মীর রহস্যমৃত্যু হয়েছে। অনেক নেতা ও কর্মীকে বাড়ি থেকে বেশ কিছু দূরে জঙ্গলে, বা বাজারে, বা অন্য কোনও দোকানের বারান্দায় গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলতে দেখা গিয়েছে। যদিও তাঁদের অনেকের শরীরেই আঘাতের চিহ্ন দেখা গিয়েছে। ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হওয়া ব্যক্তিদের কারও কারও পা মাটিতে স্পর্শ করেছিল বলে অনেকের দাবি। আবার কাউকে কাউকে অদ্ভুত ভাবে ফাঁসে ঝুলে থাকতে দেখা গিয়েছে, যেখান থেকে ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হওয়া রীতিমতো বিস্ময়কর বলে অনেক বিজেপি নেতাই দাবি করেছেন। ফলে সেইসব মৃত্যু নিয়েও অনেক বিতর্ক হয়েছে। অধিকাংশ ঘটনাকেই পুলিশ আত্মহত্যার ঘটনা বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু সেইসব ঘটনায় নিহতদের পরিবার এবং বিজেপির পক্ষে আদালতে অনেকবারই মামলা করা হয়েছে। সেইসব মামলা এখনও বিচারাধীন। পূর্ব মেদিনীপুরের বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, দেবাশিকে খুন করে সেই ভাবেই পরিকল্পিত ভাবে দুর্ঘটনার তত্ত্ব দাঁড় করাতে চাইছে পুলিশ।