যেকোন কিশোর অভিবাসী ফ্রান্সে এসে নিজেকে অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক ঘোষণা করলে তাকে অবশ্যই স্থানীয় ডিপার্টমেন্টের আওতায় একটি প্রশাসনিক মূল্যায়ন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এই পদ্ধতির লক্ষ্য হচ্ছে আবেদনকারীর বয়স ও অভিভাবকত্বহীন কিনা তা নির্ধারণ করা। আবেদনকারীকে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে নিশ্চিত করা হলে তার সব দায়িত্ব ফরাসি সরকারের শিশুদের জন্য সামাজিক সহায়তা বিষয়ক দপ্তর (এএসই) নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ফ্রান্স স্বাক্ষরিত শিশু অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন এর আওতায় সুরক্ষিত থাকবে।
৩০ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে জারিকৃত একটি ডিক্রি অনুযায়ী (এই ডিক্রিটি আশ্রয় ও অভিবাসন আইন ২০১৮ এর ভিত্তিতে জারি করা হয়েছে ) অপ্রাপ্তবয়স্ক মূল্যায়ন ব্যবস্থার উল্টো পরিণতি হতে পারে। এখন থেকে, একজন কিশোর ফ্রান্সে আসার পরে নির্দিষ্ট একজন সমাজকর্মীর মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে মূল্যায়নের আগে সরাসরি ডিপার্টমেন্টের একটি নির্দিষ্ট শাখার মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে।
ডিপার্টমেন্টগুলো এখন থেকে কোন কিশোরকে অপ্রাপ্তবয়স্ক মূল্যায়নের সময় প্রিফেকচারগুলিকে জাতীয় বায়োমেট্রিক ফাইল (এইএম) এর সাহায্য নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
নতুন এই পদ্ধতিতে একজন কিশোরের আঙুলের ছাপ ও ছবি সংগ্রহ করা হবে এবং তার পরিচয় সংক্রান্ত প্রশাসনিক কাগজপত্র যাচাই করা হবে। এছাড়া প্রেফেচুর কর্তৃপক্ষ ব্যক্তির ভিসা, পাসপোর্ট অথবা অন্য যেকোন নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সাথে জাতীয় বায়োমেট্রিক তথ্যভান্ডারের সাথে মিলিয়ে দেখবে। তথ্য যাচাইয়ের প্রেক্ষিতে কোন কিশোরকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে সাব্যস্ত হলে প্রেফেকচুর তার বিরুদ্ধে বহিষ্কারাদেশ জারি করতে পারবে। এছাড়া তাকে একটি নির্দিষ্ট আটক কেন্দ্রেও রাখা হতে পারে।
অর্থ্যাৎ, অনেক ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক নির্ধারণের ভাগ্য পুরোপুরি ডিপার্টমেন্ট এর নির্দিষ্ট শাখা এএসই বা সমাজকর্মীদের উপর নির্ভর করবে না। এটি এখন থেকে প্রেফেকচুর বা রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে সংযুক্ত ডিজিইএফ (ফ্রান্সে বিদেশিদের জন্য সাধারণ অধিদপ্তর) থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৩টি ডিপার্টমেন্ট এই নতুন এইএম ব্যবস্থা প্রয়োগ করেছে এবং জাতীয় বায়োমেট্রিক তথ্যকেন্দ্রে ইতোমধ্যে ১১ হাজার কিশোরের তথ্য নিবন্ধন করা হয়েছে।
ক্রমান্বয়ে বাধ্যতামূলক?
সংস্থা এবং এনজিওগুলোর আশংকা যদি এএইএম প্রয়োগের বিষয়টি সব ডিপার্টমেন্টে বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয় সেক্ষেত্রে কিশোররা নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
সরকারের মুখপাত্র ‘আদ্রিয়া তাকে’ সম্প্রতি ১৬ জুন সারা দেশে এএইএম ব্যবস্থায় সব কিশোরের তথ্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে শিশুদের সুরক্ষা সম্পর্কিত একটি নতুন আইন উপস্থাপন করেছেন। এই বাধ্যবাধকতাটি ইতোপূর্বে ‘৪ ডি’ বা প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ সংক্রান্ত বিলেও তুলে ধরা হয়েছিল। তবে সংসদ ও সিনেটে এই আইনটির এখনও পরিক্ষা-নিরীক্ষা বাকি আছে। অবশ্য নতুন আইনে যাই হোক না কেন ধারণা করা হচ্ছে ক্রমান্বয়ে দেশজুড়ে এইএম ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হবে।
একটি সূক্ষ ফাঁদ
এইএম প্রয়োগের ব্যাপারটি শুরু থেকেই ঐচ্ছিক হিসেবে বলা হলেও ২০১৯ এবং ২০২০ সালে অনেকগুলো ডিপার্টমেন্ট পরীক্ষামূলকভাবে এই ব্যবস্থাটি প্রয়োগ করেছে। কিন্তু ২৩ জুন ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি ডিক্রি ডিপার্টগুলোকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। কারণ ডিক্রি অনুযায়ী সরকারের অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্কদের আশ্রয় সংক্রান্ত দপ্তর থেকে যেসব ডিপার্টমেন্ট এইএম প্রয়োগ করেনি তাদের জন্য শাস্তি হিসেবে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থ্যাৎ, পরোক্ষাভাবে ডিপার্টমেন্টগুলোকে নতুন ব্যবস্থা প্রয়োগে বাধ্য করা হচ্ছে।
এই ডিক্রির বিরুদ্ধে সেইন সেন্ট ডেনিস এবং ভাল দ্য মার্ন নামক দুটি ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের আইন বিভাগে সর্বোচ্চ পরামর্শক কনসেই দেতা বরাবর আপিল করা হয়েছে।
নতুন ব্যবস্থার সম্ভাব্য প্রভাব
নতুন এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কিশোররা যেন কোন ডিপার্টমেন্ট থেকে আবেদন খারিজ হওয়ার পরে ফ্রান্সের আর কোন ডিপার্টমেন্টে আবেদন করতে না পারেন তা জোরদার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তবে শুরু থেকেই বিতর্কিত এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংস্থা এবং এনজিওগুলো সোচ্চার। ইতোমধ্যে ১৯টি সংস্থা সম্মিলিতভাবে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা ও শিশুদের সর্বোচ্চ সুরক্ষার কারণ দেখিয়ে ফরাসি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনি কাঠামো ‘কনসেই দেতা’ বরাবর আপিল করে এই ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
আবেদনকারীরা এই ব্যবস্থার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এর ফরে অপ্রাপ্তবয়স্কদের সুরক্ষা না দেওয়া, আটকে রাখা বা এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রবল ঝুঁকি রয়েছে। সংস্থাগুলোর মতে, প্রকৃতপক্ষে এই ব্যবস্থায় অভিবাসনকালীন ভ্রমণের বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ককে তার নিজের দেশের সীমানা অতিক্রম করার জন্য বয়স বাড়িয়ে প্রাপ্তবয়স্ক পাসপোর্ট তৈরি করতে হয়েছে। যার কারণে তার ভিসা বা যেকোন নথিতে প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে নিবন্ধন করা আছে।
শুধু এই তথ্যের ভিত্তিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মূল্যায়ন করা হলে বেশ বড় সংখ্যক কিশোরদের আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
সুত্র :ইনফোমাইগ্রেন্টস