কলকাতা সংবাদদাতা: পশ্চিমবাংলার বিধানসভায় এবার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি) চেয়ারম্যান পদ নিয়ে দড়ি টানাটানি শুরু হয়ে গেল। বুধবার বিজেপির পক্ষে ৬ জন, তৃণমূলের পক্ষ ১৩ জন এবং একক ভাবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন বিজেপি থেকে তৃণমূলে ফেরা মুকুল রায়। আর, এই ঘটনার পরই বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো জলঘোলা হতে শুরু করেছে।
এদিন বিজেপির পক্ষে যাঁরা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন, তাঁরা হলেন অশোক লাহিড়ি, শুভেন্দু অধিকারী, বিবেকানন্দ বাউরি, অম্বিকা রায়, বঙ্কিম ঘোষ এবং নিখিলরঞ্জন দে। তৃণমূলের তরফে ১৩ জন মনোনয়ন জমা দিলেও কংগ্রেস এবং সিপিএমের কোনও প্রতিনিধি এবার বিধানসভায় না থাকায় তাদের কেউই মনোনয়ন জমা দেননি। সাধারণত পিএসি–র সদস্য সংখ্যা ২০ জন হয়। সে দিক থেকে হিসেবটা ঠিকই আছে। বিজেপির ৬, তৃণমূলের ১৩ এবং মুকুল রায় নিজে। এখন প্রশ্ন হল, এই ২০ জনের মধ্যে চেয়ারম্যান কে হবেন?
সাংবিধানিক রীতি অনুযায়ী, বিরোধী দল থেকেই একজনকে চেয়ারম্যান করা হয়ে থাকে। সেই হিসেবে বিজেপি চাইছে তাঁদের বিধায়ক তথা অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ি চেয়ারম্যান হন। তৃণমূল এখনও তাদের পছন্দের চেয়ারম্যানের নাম ঘোষণা করেনি। তবে সূত্রের খবর, মুকুল রায়কেই তারা চেয়ারম্যান হিসেবে চাইছে। আবার মুকুল রায়ের চেয়ারম্যান পদে যাওয়া নিয়ে তীব্র আপত্তি রয়েছে বিজেপির। কারণ, বিজেপি বিধায়ক হিসেবে তাঁর তৃণমূলে যোগদানের পরই তিনি বিধায়ক পদে ইস্তফা দিতে পারতেন। অথবা বিধায়ক পদ চলে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তৃণমূলের পরামর্শে তিনি বিধায়ক পদ ছাড়েননি। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর বিধায়ক পদ এখনও খারিজ করেননি। যদিও তাঁর বিধায়ক পদ খারিজ করার দাবি জানিয়েছে বিজেপি।
সাধারণত বিধানসভার কোনও পর্বেই পিএসি চেয়ারম্যান পদ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয় না। রীতি মেনে শাসক দল বিরোধী দলের মনোনীত ব্যক্তিকেই পিএসি চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু গতবার থেকেই এই রীতি লঙ্ঘন করে চলেছে তৃণমূল। যেমন, গত বিধানসভা নির্বাচনের পর নতুন তৃণমূল সরকার গঠিত হলে পিএসি চেয়ারম্যান করা হয় বিধায়ক মানস ভুঁইয়াকে। তাঁকে বিধানসভায় খাতায় কলমে কংগ্রেস বিধায়ক দেখানো হলেও তিনি ততদিনে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। সেজন্য বিরোধী নেতারা আড়ালে তখন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরপেক্ষতা যে সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়, সে দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন।
যাই হোক, মানস ভুঁইয়া রাজ্যসভার সাংসদ হয়ে গেলে পিএসি–র চেয়ারম্যান করা হয় রানাঘাটের শঙ্কর সিংকে। খাতায় কলমে তিনি তখন কংগ্রেসের বিধায়ক হলেও আসলে তখন তিনি তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। তাই পিএসি চেয়ারম্যান পদ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল যে বিধানসভায় অনৈতিক খেলা খেলছে, সে কথা বলে থাকেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা। বিজেপি নেতাদের মতে, এবারও মুকুল রায় বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দিলেও স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় না চাইলে তাঁর বিধায়ক পদ যাবে না। আর বিজেপি ছাড়ার পুরস্কার হিসেবে তাঁকেই পিএসি চেয়ারম্যান করবেন মমতা।
সূত্রের খবর, বিজেপি নেতারা আশঙ্কা করছেন, ঘুর পথেই তৃণমূল এবার মুকুল রায়কে পিএসি–র চেয়ারম্যান করবে। কারণ, বিধানসভায় আসন সংখ্যার নিরিখে পিএসি–তে বিজেপির সদস্য সংখ্যা ৬ জন হয়। এবার তাদের ৬ জনই মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। অন্যদিকে, সেই আসন সংখ্যার প্রেক্ষিতে তৃণমূলের সদস্য সংখ্যা হওয়া উচিত ১৪ জন। কিন্তু তৃণমূলের হয়ে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন ১৩ জন। অর্থাৎ একজন কম। মুকুল রায় বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। মনে করা হচ্ছে, তাঁর জন্যই তৃণমূল একজনের মনোনয়ন কম দিয়েছে। তাঁকে ধরে সংখ্যাটা ১৪ হয়ে যায়। তা হলে ২০ সদস্যের পিএসি–তে মোট সদস্য সংখ্যা মিলে যাচ্ছে।
তবে এ বিষয়ে বিজেপি কড়া অবস্থান নিয়েছে। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, যদি মুকুল রায় পিএসি–র চেয়ারম্যান হন, তা হলে সেই কমিটিতে তাঁর দলের কোনও প্রতিনিধি থাকবেন না। তা হলে বিধানসভায় পিএসি কার্যত তৃণমূলের কমিটি হয়েই থাকবে। তা ছাড়া আর এক বিজেপি নেতা জানিয়েছেন, পিএসি চেয়ারম্যান হলে তাঁকে অনেক হিসেব নিকেশ করতে হবে। সরকারি আয়–ব্যয়ের দিকে আতশ কাচ দিয়ে বিচার করে পিএসি। মুকুল রায় কি সে–সব পারবেন? তা হলে কোন সাহসে তিনি চেয়ারম্যান হবেন? তিনি কি কোনও দিন কোনও হিসেব নিকেশের ধার ধরেন? ওই পদে অশোক লাহিড়ির মতো অর্থনীতিবিদই যোগ্য।
তৃণমূল অবশ্য বিজেপির যুক্তিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। বিজেপির কোনও প্রতিনিধি না থাকলেও কোনও পরোয়া নেই তাদের। তৃণমূল সদস্যরাই কমিটি চালাবেন বলে দলের বিধায়করা জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিজেপি জানিয়েছে, সাংবিধানিক রীতি না মেনে যদি মুকুল রায়কেই পিএসি–র চেয়ারম্যান করা হয়, তা হলে ধরে নিতে হবে, সরকারি আয়–ব্যয় ঠিক নিয়ম মেনে হয় না। সেখানে অনেক কারচুপি থাকে। তাই পিএসি–কে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে চান মুখ্যমন্ত্রী। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, মুকুল রায়কে পিএসি–র চেয়ারম্যান করা হলে আইনের রাস্তায় যেতে পারে বিজেপি।
বিষয়টি নিয়ে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘প্রত্যেক বার আলোচনার মাধ্যমে পিএসি–র চেয়ারম্যান মনোনীত হয়ে থাকেন। এবার ছবিটা স্পষ্ট নয়। বিধানসভার নিয়ম ও স্পিকারের অধিকার মেনেই এবার চেয়ারম্যান মনোনীত হবেন।’ যদিও বিমানবাবুর কথার ওপর বিরোধীদের একেবারেই ভরসা নেই। বিরোধী বিধায়কদের অনেকেই ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, তিনি তৃণমূল বিধায়ক হিসেবে ভোটে জিতে বিধানসভা স্পিকার পদে শপথ নেওয়ার পরও দলীয় পরিচয় থেকে বের হতে পারেন না। গেল বিধানসভাতেও তাঁর আচরণে সেই প্রমাণ বহুবার পাওয়া গিয়েছে।
যেমন বিরোধী বিধায়করা তৃণমূলে যোগদান করার পর বিরোধী দলের তরফে সেই বিধায়কদের পদ খারিজ করার জন্য তাঁকে চিঠি দেওয়া হলেও তিনি কোনও পদক্ষেপই করেননি। চুপ করে থেকেছেন। এবারও বিরোধী দলনেতা হিসেবে শুভেন্দু অধিকারী স্পিকারকে চিঠি দিয়ে মুকুল রায়ের বিধায়ক পদ খারিজের দাবি জানিয়েছেন। মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে দলত্যাগ বিরোধী আইন প্রয়োগের দাবি জানিয়েছেন শুভেন্দু। যদিও স্পিকার এ বিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। পুরো বিষয়টি নিয়ে আগের বারের বিধানসভার মতোই চুপ করেই রয়েছেন।