বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: তৃণমূলের মুখপত্রে সিপিএম সদস্যার নিবন্ধ প্রকাশ নিয়ে তুমুল চর্চা চলছে বাংলার রাজনীতিতে। নিবন্ধটির বিষয় ‘বঙ্গ রাজনীতিতে নারীশক্তি’। লেখার শিরোনামের উপরে লেখা হয়েছে, প্রাক্ স্বাধীনতা পর্ব থেকে সাম্প্রতিককালের ইতিহাসের চালচিত্রে বাঙালি মহিলাদের অবদান। শুধু তাই নয়, তাতে স্ট্র্যাপে লেখা হচ্ছে ‘বাসন্তীদেবী থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’। আর সেটাই জল্পনার মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। তৃণমূল মুখপত্রে নিবন্ধটি লিখেছেন প্রয়াত অনিল বিশ্বাস কন্যা অজন্তা বিশ্বাস।
বাংলার পাঠক মহলে বাম জমানায় সিপিএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’ প্রভাব ছিল অত্যন্ত বেশি। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসলে ‘গণশক্তি’র দাপট কমতে থাকে। তার বদলে উঠে আসতে শুরু করে তৃণমূলের মুখপত্র ‘জাগো বাংলা’। এতদিন পত্রিকাটি সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হত। ২১ জুলাই পত্রিকাটি দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হতে শুরু করে। প্রথম দিন থেকেই পত্রিকাটি নিয়ে বাংলার রাজনীতি, সংবাদ মাধ্যম এবং পাঠক মহলে তুমুল কৌতূহল তৈরি হয়। সেই পত্রিকাতেই ধারাবাহিক ভাবে উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখছেন সিপিএম সদস্যা অজন্তা বিশ্বাস। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলার রাজনীতিতে এক সময় সাপে–নেউলে সম্পর্ক ছিল যে দুই রাজনৈতিক শক্তির, তাদের মধ্যে কি সেই সম্পর্কের অবসান ঘটতে চলেছে?
ক্ষমতায় থাকার সময় বামফ্রন্ট, বিশেষ করে সিপিএমের প্রধান শত্রু হয়ে উঠেছিলেন প্রথমে যুব কংগ্রেস নেত্রী, পরবর্তী কালে তৃণমূল কংগ্রেস দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম জমানার অবসান হলে মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা। তবু তাঁর সঙ্গে সেই শত্রুতা বিন্দুমাত্র কমেনি সিপিএমের। এই বৈরিতা প্রত্যক্ষ ভাবে বজায় ছিল দশ বছর। কিন্তু সব এলোমেলো করে দিয়েছে এই ২০২১–এর বিধানসভা নির্বাচনের ফল। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেই সিপিএমের শক্তিক্ষয়ের ইঙ্গিত ছিল। ৪২টি আসনের মধ্যে একটিও পায়নি তারা। তবে ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে একেবারে শূন্য হয়ে যায় এক সময়ের চরম প্রভাবশালী এই বাম দলটি। তার পরেই সিপিএমের ভেতরে রীতিমতো অসন্তোষ এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিভেদ দেখা দিতে শুরু করেছে।
সিপিএমের একটি পক্ষ দলের অস্তিত্ব রাখতে তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলাতে চাইছে। মুখে তারা বলছে, বিজেপি দেশের বড় শত্রু। সুতরাং বিজেপির শক্তি থেকে দেশকে রক্ষা করতে তৃণমূলের সঙ্গেই চলা উচিত সিপিএমের। অপর পক্ষ ঠিক তার বিপরীত দিকে অবস্থান করছে। তারা মনে করছে, তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলানোর যুক্তি ‘ভাবের ঘরে চুরি’ ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, তাতে সিপিএম আরও শেষ হয়ে যাবে। দলের অভ্যন্তরে তারা এমন কথাও বলেছে, তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলালে মমতার মতো আগ্রাসী নেত্রী বাংলায় গোটা সিপিএম দলটাকেই গ্রাস করে নেবেন। তখন হা–হুতাশ করা ছাড়া সিপিএমের আর কিছুই করার থাকবে না। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সিপিএম যখন বেসামাল, তখন অজন্তা বিশ্বাসের এমন একটি পদক্ষেপ তাদের আরও বিভ্রান্ত করে দিয়েছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
বলা হয়ে থাকে, প্রমোদ দাশগুপ্তর প্রিয় পাঁচ তরুণ বাম নেতার একজন ছিলেন অনিল বিশ্বাস। অজন্তা বিশ্বাসের বাবা অনিলবাবু চিরকালই মমতার কড়া সমালোচক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে সিপিএমের সর্বক্ষণের কর্মী ছিলেন। এক সময় দলীয় মুখপাত্র গণশক্তি পত্রিকার সম্পাদকও হন। পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হন। তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সিপিএমকে অনেক বিতর্ক থেকে উতরে দিয়েছিল বলে অনেক রাজনীতি বিশ্লেষকই মনে করেন। ২০০৬ সালের ২৬ মার্চ ভোটের ঠিক আগে অনিল বিশ্বাস প্রয়াত হন। ভোটকুশলী অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুতে সিপিএমের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়ে যায়। পরবর্তী কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলন যে ভাবে তাদের বিপাকে ফেলে দিয়েছিল, অনেক রাজনীতি বিশেষজ্ঞের মতে, অনিল বিশ্বাসের মতো যোগ্য নেতার অভাবে তারা তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
সেই অনিলবাবুর মেয়ে অজন্তা বিশ্বাস তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপত্র ‘জাগো বাংলা’য় উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখায় রাজনৈতিক মহলে রীতিমতো চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। বুধবার থেকে ওই নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। কিস্তি হিসেবে শুক্রবার পর্যন্ত তিনটি কিস্তি প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। শনিবার বের হওয়ার কথা চতুর্থ কিস্তির। তবে সেই অর্থে রাজনৈতিক নিবন্ধ নয় এটি। অজন্তা এখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্বাবিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। ‘জাগো বাংলা’য় তাঁর লেখার সঙ্গে এই পরিচিতিই দেওয়া হয়েছে। অজন্তা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী ছিলেন। কলেজ জীবনে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি কখনওই সে ভাবে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসেননি। মূলত লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন। পরে যোগ দিয়েছেন অধ্যাপনায়। সেই সূত্রেই জাগো বাংলায় তাঁর এই উত্তর সম্পাদকীয়।
বামপন্থী এবং অবামপন্থী, রাজনীতির বিভিন্ন ধারায় যোগ দিয়ে বাঙালি নারীরা কী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন অজন্তা। সেই তালিকায় এসেছে বাসন্তীদেবীর সঙ্গেই ঊর্মিলাদেবী, সুনীতিদেবী, সরোজিনী নাইডু, মোহিনী দাশগুপ্ত, বীণাপাণি দেবীর মতো নারীদের কথা। মণিকুন্তলা সেনের মতো কনক মুখোপাধ্যায়, রেণু চক্রবর্তীর পাশাপাশি কৃষক আন্দোলনে ইলা মিত্র, শ্রমিক আন্দোলনে সুধা রায়ের অবদানের কথাও লিখেছেন তিনি। লিখেছেন প্রবীণ কংগ্রেসনেত্রী ফুলরেণু গুহের কথা। সময় সরণি ধরে ধাপে ধাপে আসছে বিভিন্ন নারীর কথা। সকলের আগ্রহ রয়েছে, তাঁর লেখায় কবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা আসবে, তা নিয়ে। শুক্রবার নিবন্ধের তৃতীয় কিস্তিতে তিনি প্রবীণ কংগ্রেসনেত্রীর স্মৃতিচারণ করেছেন। এদিনও তাঁর লেখায় মমতা–প্রসঙ্গ আসেনি।
এ কথা ঠিক, তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপত্রে নিশ্চয়ই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা প্রকাশিত হবে না। তা হলে তিনি কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করবেন? লক্ষ টাকার প্রশ্ন সেটাই। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল সিপিএমের অন্দরেও। কেন তিনি তৃণমূল মুখপত্রে উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখছেন, কেন সেখানে মমতার প্রসঙ্গ আসছে, তাঁকে নিয়ে অজন্তা কী লিখবেন, তা নিয়ে আলিমুদ্দিনে কানাঘুঁষো চলছেই। তবে সিপিএম দলগত ভাবে নির্দেশ দিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও নেতা মুখ খুলবেন না। অর্থাৎ, মৌনব্রত অবলম্বন করে সিপিএম বিতর্কটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তবে সিপিএম এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই মুখ খুলে ফেলেছিলেন সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী। তিনি বলেছেন, ‘আমরা কারও ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি না। দলের যে কেউ অন্য কোথাও লেখালেখি করতেই পারেন। এ বিষয়ে দল কাউকে বারণ করেনি।’ তবে দলের সিদ্ধান্ত জানার পর তিনি আর কোনও মন্তব্য করেননি।
কিন্তু সূত্রের খবর, দলের কিছু নেতা অজন্তার কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চেয়েছেন। অজন্তা নাকি তাঁদের জবাব দিয়েছেন, বিতর্ক বেশি দূর গড়ালে তিনি নিশ্চয়ই উত্তর দেবেন। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি কড়া কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন অজন্তা? ইতিমধ্যে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ইতিমধ্যে অনেক সিপিএম নেতা ও কর্মী তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, অজন্তাও কি সেই পথেই যেতে চলেছে? এমন ধারণার কারণ হিসেবে কেউ কেউ মনে করছেন, অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুর পর সিপিএম নেতৃত্বের সঙ্গে দলগত স্তরে খানিকটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল অজন্তার পরিবারের। ঘনিষ্ঠ মহলে সেই সিপিএম নেতারা জানিয়েছেন, রাজনীতির আঙিনা ছাড়িয়েও মমতার সঙ্গে নাকি অজন্তার পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
তাই সিপিএম বিষয়টি নিয়ে সতর্ক রয়েছে। এই মুহূর্তে দল চায় না, নতুন করে কেউ অন্য দলে চলে যান। তাই অজন্তার বিষয়ে কড়া কোনও পদক্ষেপ সিপিএমের তরফে করা হবে না বলেই দলের কিছু নেতা ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, বাম জমানায় সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে নয়াচর, বাংলার শিল্পায়নের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে আন্দোলন করেছিলেন, স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন বাংলায় শিল্প–উন্নয়নের গতি, তাকে বাম সরকার বা বাম নেতারা কোনও দিনই ভালো চোখে দেখেননি। সকলেই বলেছিলেন, মানুষকে মিথ্যে কথা বলে এবং ভুল বুঝিয়ে বিপথে চালিত করেছেন মমতা। সেই সময় দাপুটে বাম মন্ত্রী গৌতম দেব মমতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘প্যাথোলজিক্যাল লায়ার।’ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও তাঁর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতেন না। একবার তো বলেই ফেলেছিলেন, ‘তাঁর নাম উচ্চারণ করতে ঘৃণা হয়।’
এখন দেখার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কী মূল্যায়ন করেন অজন্তা!