মো. সাব্বির আহাম্মেদ: ‘Lepidoptera’ বর্গের অন্তর্গত প্রাণী প্রজাপতি প্রকৃতির অপরূপ এক সৃষ্টি। দিনের বেলায় সক্রিয়, বাহারি রঙের এসব প্রাণীরা মানুষের মনে নান্দনিকতার সৃষ্টি করে। এদের ডানার বিভিন্ন আকার-আকৃতি, রঙ এবং শিরাবিন্যাস মূহুর্তেই মন ভালো করে দিতে পারে। অ্যান্টার্টিকা মহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর সকল জায়গাতেই প্রজাপতির দেখা মেলে।
সকল ধরণের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের জন্যে প্রজাপতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরা স্বাস্থ্যকর পরিবেশের সূচক। একটি স্থানের প্রজাপতির অবস্থা দেখে সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পরাগায়নে এরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও খাদ্যশৃঙ্খলের গূরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে প্রজাপতি-পাখিসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গভোজী প্রাণির খাদ্য হিসেবে গৃহীত হয়। প্রজাপতির অর্থনৈতিক গুরুত্ব সময়ের সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদের আঁইশের গঠন দেখেই বিজ্ঞানীরা সোলার প্যানেল উদ্ভাবনের ধারণা পান। বর্তমান বিশ্বে ইকোট্যুরিজম দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে প্রজাপতি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষের ভ্রমণের জন্য প্রজাপতি পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। এর ফলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। এছাড়াও প্রজাপতির বিভিন্ন অন্তর্নিহিত, শিক্ষাগত, ও সৌন্দর্যগত মূল্য রয়েছে।
সারা বিশ্বে ২০ হাজারের বেশি প্রজাতির প্রজাপতি পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ প্রজাপতির দিক থেকে বেশ সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। বাস্তুসংস্থাঙ্গত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে প্রজাপতির ৪ ধরণের বাসস্থান দেখা যায়। এগুলো হলো মিশ্র-চিরহরিৎ বনাঞ্চল, পত্রঝরা বনাঞ্চল বা শালবন, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, এবং সমতল ভূমি। বর্তমানে বাংলাদেশে সর্বমোট ৪২১ প্রজাতির প্রজাপতি পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন তার সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এই সংখ্যা উল্লেখ করেন। এর পূর্বে ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএন এর লাল তালিকায় (IUCN Red List 2015) ৩০৫ প্রজাতির প্রজাপতির কথা উল্লেখ করা হয়।
২০১৫-২০২৩ এই সময়ে সর্বমোট ১১৬টি প্রজাতি বাংলাদেশের প্রজাপতির তালিকায় যুক্ত হয়। প্রজাতিগুলো ৯টি পরিবারের অন্তর্গত-এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১২৫ প্রজাতি ‘Lycaenidae’ পরিবারের অন্তর্ভূক্ত। বাকি পরিবারগুলোতে যথাক্রমে ‘Hesperiidae’ পরিবারে ৮৬, ‘Nymphalidae’ পরিবারে ৭৯, ‘Pieridae’ পরিবারে ৩৬, ‘Satyridae’ পরিবারে ৩৫, ‘Papilionidae’ পরিবারে ৩২, ‘Danaidae’ পরিবারে ১৯, ‘Riodinidae’ পরিবারে ৪, ‘Amathusiidae’ পরিবারে ৪, এবং ‘Acraeidae’ পরিবারে ১ টি প্রজাতি অন্তর্ভূক্ত। বাংলাদেশের একটি স্থানীয় (Endemic) প্রজাপতি রয়েছে যার নাম হচ্ছে ‘Sundarban Crow (Euploea crameri nicevillei)’। অর্থাৎ এই প্রজাতি বাংলাদেশ ব্যাতীত বিশ্বের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে দেখা যায়।
প্রজাপতি নিয়ে বাংলাদেশে তুলনামূলক কম গবেষণা করা হয়। বিভিন্ন কারণে অনেক প্রজাতি বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন। এর মধ্যে বনাঞ্চল ধ্বংস, পোষক উদ্ভিদ কমে যাওয়া, অতিমাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতির অনন্য সুন্দর এই সৃষ্টিকে রক্ষা করার আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। এদের সংরক্ষণের জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে, গবেষণাকার্য বৃদ্ধি করতে হবে যা ভবিষ্যতে আমাদের দেশের বাস্তুতন্ত্রের জন্যে সুফল বয়ে আনবে।
মো. সাব্বির আহাম্মেদ
শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা