বৈষম্যের চাদর চিরে সাম্যের আহ্বানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
— নাইম ইসলাম নিবির
দীর্ঘ নয় মাস মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে যেসকল সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার কিংবা প্রত্যাশা ছিল, তার মধ্যে অন্যতম হলো সমাজের সর্বস্তরে সাম্য বা সমতা প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ শোষণ উৎপীড়নে নিষ্পেষিত মুক্তিকামী বাঙালি জাতির বৈষম্য বিলোপের প্রত্যয় ছিল সম্মুখ কাতারে। কেবলমাত্র বৈষম্যের চাঁদরে মোড়ানো ভূখণ্ড হতে নিজেদের মুক্ত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদক্ষ নেতৃত্ব ও ডাকে সাড়া দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু দুঃখ ও হতাশাজনক বিষয় হলো, যেই সাম্যের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জাতির কৃতি সন্তানেরা নিজের জীবন বিলীন করে দিয়ে শহীদ হয়েছিল সেই আকাঙ্ক্ষা আজও পরিপূর্ণভাবে পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আমরা পাকিস্তানি বাহিনীদের হাত থেকে সেদিন মুক্তি লাভ করেছিলাম ঠিকই কিন্তু আমরা আমাদের নিজ জাতির বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তি লাভ করতে পারিনি।
আমাদের সমাজের অর্থনীতি ব্যবস্থা, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ প্রায় প্রতিটি স্তরে প্রতিনিয়ত আমরা নিজ জাতির কাছেই বৈষম্য ও শোষণের শিকার হচ্ছি। তবে এই বৈষম্য নিরসনে সাম্য প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে প্রচেষ্টা চলিয়ে যাচ্ছে। যা প্রমাণ পাওয়া যায় জাতীয় সংসদে ‘বৈষম্যবিরোধী বিল-২০২২’ উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে। এবছরের গত ৫ এপ্রিল বৈষম্যবিরোধী বিলটি উপস্থাপিত হয়েছে। বিলটি সংশ্নিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পর্যালোচিত হচ্ছে।
আমাদের সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশের সব নাগরিক আইনের চোখে সমান হিসেবে বিবেচ্য। ধর্ম, বর্ণ, জাতি বা জন্মস্থানই শুধু নয়; একজন মানুষ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করবে। একজন নাগরিক তার ক্ষমতাসীনদের কাছে সসর্বক্ষেত্রে ন্যায্য ও ন্যায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হবেন। এবং এ বিষয়টিও সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের এই বিধানের বাস্তব প্রতিফলনে যে আইন প্রয়োজন, তা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মত করে ইতিপূর্বে কোন সরকার কাজ করেনি। যার স্পষ্ট ধারণা মেলে বৈষম্যবিরোধী উপস্থাপিত বিলটির মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এ জন্য সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার। সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষদের ব্যাপারে এই বিলে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হয়েছে। যা অত্যন্ত সময়োপযোগী আলোকপাত বলে আমি মনে করি।
তবে আর একটি বিষয় আয়ামাদের মানতেই হবে, আমাদের দেশে জনকল্যাণ নিশ্চিতকল্পে অনেক আইন থাকলেও এসব আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিয়ে নানা মহল থেকে অতীতে নানাবিধ নেতিবাচক কথা ও গুঞ্জনের সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে বিগত সময়গুলোতে এতো কিছুর পরেও বৈষম্যবিরোধী বিলের ব্যাপারে আশার কথা হলো, ভুক্তভোগীদের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে যে মনিটরিং কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাতে বৈষম্য নিরসনে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের রাখার পাশাপাশি নিম্নবর্গ শ্রেণি থেকে প্রতিনিধিও সংযুক্ত করা হয়েছে। মনিটরিং কমিটির ক্ষমতা, কাজের পরিধি, প্রতিকারের প্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে কোনো কোনো মহল থেকে কিছু বিষয় সুনির্দিষ্ট করে যে আলোচনা হয়েছে, তার সবটুকুই সংসদীয় কমিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রমে আমলে রাখা অতিব গুরুত্বপূর্ন।
প্রিয় পাঠক! আমাদের সমাজে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও একই সঙ্গে দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে কথা বলে শেষ করা যাবে না। তাই আমার আজকের আলোচনা সেদিকে আর নাইবা নিলাম। তবে আমরা আশা করব বর্তমান বাজেটে বৈষম্যবিরোধী বিল ২০২২ এর ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার প্রভাবের ছায়া যেন না পড়ে। আমার সাথে সহমত পোষণ করে পাঠকগণও নিশ্চয় তা-ই চাইবেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে কয়েকটি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে জানতে পেরেছি বাংলাদেশের শহরগুলোতে ধর্ম, উপার্জনের সক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধাসহ নানা বিষয় ঘিরে গত এক দশকে তাদের ভাষায় আশঙ্কাজনক বিভাজন লক্ষ্য করা গেছে। সংস্থাগুলো তাদের প্রতিবেদনে বলছে, মানুষে মানুষে বিভাজন-বৈষম্য বেড়ে চলেছে। বৈষম্যবিরোধী বিল ২০২২ বাস্তবায়নে সংস্থাগুলোর গবেষণা আমলে নিলে বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে সহায়ক হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বৈষম্য নিয়ে নানা কথাই হয়ে থাকে। বিশেষ করে করোনা-দুর্যোগ প্রসঙ্গটি আরও সামনে নিয়ে এসেছিল। করোনার দাপট এখন ম্রিয়মাণ বলা চলে। কিন্তু এর অভিঘাতে সমাজে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা উপশমে সময় লাগবে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়িয়েছে বটে কিন্তু সরকারের এসব কর্মসূচি যারা বাস্তবায়ন করবেন তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতি-অস্বচ্ছতার অভিযোগও উঠেছে অনেক।
অস্বীকার করা যাবে না যে, বৈষম্য সব সমাজেই কমবেশি বিদ্যমান এবং কোনো কোনো দেশে উন্নয়ন-অগ্রগতি সত্ত্বেও মানুষে মানুষে ব্যবধান-বিভাজন তো ঘোচেইনা, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। ঠিক যেন প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো ঘটনা। তবে একটি বিষয় অস্বীকার করলে চলবে না যে সভ্যতার ভিত্তি হলো সাম্য। দার্শনিক, সমাজ চিন্তক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সব সময় সাম্যের স্বপ্ন দেখেছেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় যুগ যুগ ধরে কৃষক, শ্রমিক তাদের শ্রম দিয়ে যে সম্পদ সৃষ্টি করেন সেই সম্পদে হাত পড়ে ক্ষমতাবান কিছু মানুষের এবং তারা তা কুক্ষিগত করে নিজেদেরকে অধিক ক্ষমতাবান বানিয়ে তোলেন। সমাজ ও রাষ্ট্রে যদি কিছু মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে যায়, অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষ যদি বঞ্চিতদের কাতারে থেকে যায়। তাহলে এর বিরূপ প্রভাব বহুমুখী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। বর্তমান রক্তস্নাত বাংলাদেশে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এ চিত্র দৃশ্যমান যা মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-প্রত্যয়ের বিপরীত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশে মাত্র ১০ মাসে আমাদের যে সংবিধান দিয়েছিলেন, তাতে মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অঙ্গীকার-প্রত্যয়েরই সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছিল। কিন্তু ‘৭৫-এর মর্মন্তুদ অধ্যায়ের পর স্বার্থান্বেষী শাসকদের অভিলাষ পূরণে দফায় দফায় এই সংবিধানে পরিবর্তন ও পরিমার্জন আনা হয়েছে। ১৯৭১-সালের ১০ ই এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এ-তিনটি মূল স্তম্ভ উল্লেখ ছিল। এগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করা অনেকাংশেই সম্ভবপর হবে। তবে সাম্য প্রতিষ্ঠায় সরকারের ভূমিকাই মুখ্যত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বৈষম্য নিরসনে সমাজের দায়িত্বশীল সব মহলেরই কমবেশি দায়িত্ব রয়েছে। শুধু রাজনৈতিক সমালোচনার জন্য সমালোচনা না করে ব্যর্থতার দায় দায়িত্বশীল সবাইকে নিতে হবে।
আমরা যে মানবিক সমতাভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখছি তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সকলের জরুরি যূথবদ্ধ প্রয়াস। বৈষম্যের মতো ব্যাধিতে আক্রান্ত থেকে আমরা উন্নয়ন-অগ্রগতির যত দৃষ্টান্তই সামনে রাখি না কেন তা মোটেও কাক্সিক্ষত টেকসইয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে না। কাজেই উন্নয়ন অগ্রগতির পাশাপাশি এ ব্যাধির নিরসন করবার প্রয়াস সর্বাগ্রে জরুরি। যা বাস্তবায়নের জন্য আইনের প্রয়োজন অবশ্যই বিবেচ্য বস্তু। তবে আইন করলেই হবে না সে আইন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জে অবশ্যই জয়ী হতে হবে। আমরা আলোচনার একেবারে প্রান্তসীমায় পৌঁছে গিয়েছি, পরিশেষে আর একটু আলোচনা করে বিদায় নেবো। সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে প্রয়োজন নতুন ও বৈচিত্র্যময় সৃজনশীল চিন্তা, নীতি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আমাদের সম্ভাবনাময় যুবসমাজকে পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগাতে হবে। তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পথ মসৃণ করতে হবে। বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করে কল্যাণকামী সবকিছু নিশ্চিত করতে এবং আমাদের লালিত অসাম্প্রদায়িক স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মানের লক্ষ্যে মূল শক্তি একাত্তরের প্রত্যয়-অঙ্গীকার ধারণ করেই এগোতে হবে।
দেশের সকল পর্যায়ের মানুষের যাতে সুফল ও সাম্য নিশ্চিত করতে হবে।
মানুষের অধিকার নিশ্চিত হলে বৈষম্যের চাদর চিরতে বাধ্য হবে। যারা পিছিয়ে আছেন, চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছেন, তাদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা সমভাবে জরুরি। তাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাশ, সংস্কৃতিবদ্ধ জীবনাধিকার নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার। বৈষম্যের চাদর চিরে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে জীবনজয়ী হবে ‘বৈষম্যবিরোধী বিল-২০২২’- এই আশা ব্যক্ত করছি। আমরা অনেক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে এসেছি। তাই এখন আর বৈষম্যের কাছে সাম্য হেরে যেতে দিতে পারি না। সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে অবশ্যই মানবিকতার আলো ছড়াবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সক্ষমদের টেনে তুলতে হবে- এটাই সামাজিক সাম্যের মন্ত্র। সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন হলো দারিদ্র্য বিমোচনের মূল শক্তি। তাই এই সমাজ ও রাষ্ট্রে বৈষ্যমের ছায়া থাকতে পারে না। এবং তা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
নাইম ইসলাম নিবির : প্রধানমন্ত্রীর স্নেহধন্য রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক
nayemulislamnayem148@gmail.com